ঈদ যাত্রায় নিহত ২৬২, ক্ষতি ৯৯৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা

প্রকাশিত: ৬:২৫ অপরাহ্ণ, জুন ২৭, ২০২৪

এবারের ঈদ যাত্রায় (১১-২৩ জুন) দেশজুড়ে ২৫১টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে ২৬২ জন নিহত ও কমপক্ষে ৫৪৩ জন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৩২ জন নারী ও ৪৪ জন শিশু। এর মধ্যে ১২৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১০৪ জন, যা মোট নিহতের ৩৯.৬৯ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৫১.৩৯ শতাংশ। এসব দুর্ঘটনায় ৯৯৮ কোটি ৫৫ লাখ ৩৭ হাজার টাকার মানব সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।

সম্প্রতি ‘রোড সেফটি ফাউন্ডেশন’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তারা নয়টি জাতীয় দৈনিক, সাতটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও ইলেক্ট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।

সড়ক দুর্ঘটনার এ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এসব দুর্ঘটনায় ৪৯ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ১৮.৭০ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ২৮ জন, অর্থাৎ ১০.৬৮ শতাংশ। সাতটি নৌ-দুর্ঘটনায় ১২ জন নিহত এবং তিনজন আহত হয়েছেন। ১৬টি রেল দুর্ঘটনায় ১৪ জন নিহত এবং আটজন আহত হয়েছেন।

এদিকে, দেশজুড়ে কেন এসব দুর্ঘটনা বাড়ছে- সেসব বিষয় পর্যালোচনা ও দুর্ঘটনা রোধে বেশকিছু পরামর্শও দিয়েছে সংস্থাটি। তারা বলছে- সড়ক পরিবহন খাতের স্বার্থবাদী গোষ্ঠী সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে গৃহীত উদ্যোগসমূহ বাধাগ্রস্ত করছে। ফলে সড়ক পরিবহন আইন সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে মূলত সড়ক পরিবহন খাতের নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার কারণে। এ অবস্থার উন্নয়নে টেকসই সড়ক পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন জরুরি।

ঈদযাত্রা ও দুর্ঘটনা পর্যালোচনা:
এবার সড়ক দুর্ঘটনায় যে পরিমাণ মানব সম্পদের ক্ষতি হয়েছে, তার আর্থিক মূল্য ৯৯৮ কোটি ৫৫ লাখ ৩৭ হাজার টাকার মতো। যেহেতু সড়ক দুর্ঘটনার অনেক তথ্য অপ্রকাশিত থাকে, সেজন্য এ হিসাবের সঙ্গে আরো ৩০% যোগ করতে হবে। iRAP (International Road Assessment Porgram) এর Method অনুযায়ী হিসাবটি করা হয়েছে। দুর্ঘটনায় যে পরিমাণ যানবাহন বা প্রপার্টি ড্যামেজ হয়েছে, তার তথ্য না পাওয়ার কারণে প্রপার্টি ড্যামেজের আর্থিক পরিমাপ নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। ঈদ উদযাপনকালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে ২০.১৫ জন নিহত হয়েছে।

উল্লেখ্য, গত বছরের ঈদুল আজহায় প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছিল ২১.৬ জন। এ হিসাবে গত বছরের তুলনায় এবছর প্রাণহানি কমেছে ৬.৭১ শতাংশ। তবে এটা কোনো টেকসই উন্নতির সূচক নির্দেশ করছে না। কারণ সড়ক পরিবহন খাতে ব্যবস্থাপনাগত কোনো উন্নতি হয়নি। গত বছরের ঈদুল আজহা উদযাপনকালের তুলনায় এ বছর বাইক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেড়েছে ১৩.৩১ শতাংশ।

বিভাগভিত্তিক দুর্ঘটনা: 
সড়ক দুর্ঘটনার এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়- ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি ৭২টি দুর্ঘটনায় ৬৭ জন নিহত হয়েছেন। সিলেট বিভাগে সবচেয়ে কম আটটি দুর্ঘটনায় সাতজন নিহত হয়েছেন। একক জেলা হিসেবে দিনাজপুরে সবচেয়ে বেশি ১৬ জন নিহত হয়েছেন। সবচেয়ে কম শরীয়তপুর, রাঙ্গামাটি, সুনামগঞ্জ, পঞ্চগড় ও কুড়িগ্রাম জেলায়। এ পাঁচটি জেলায় স্বল্প মাত্রার কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটলেও কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। রাজধানী ঢাকায় ১৮টি দুর্ঘটনায় ১৪ জন নিহত এবং ১১ জন আহত হয়েছে।

পরিসংখ্যানে শতাংশ হারে ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ২৮.৬৮%, প্রাণহানি ২৫.৫৭%, রাজশাহী বিভাগে দুর্ঘটনা ১৫.১৩%, প্রাণহানি ১২.৯৭%, চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ১৭.৯২%, প্রাণহানি ১৪.৮৮%, খুলনা বিভাগে দুর্ঘটনা ১১.১৫%, প্রাণহানি ১৩.৩৫%, বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনা ৯.১৬%, প্রাণহানি ১৩.৭৪%, সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ৩.১৮%, প্রাণহানি ২.৬৭%, রংপুর বিভাগে দুর্ঘটনা ৬.৭৭%, প্রাণহানি ৯.৯২% এবং ময়মনসিংহ বিভাগে দুর্ঘটনা ৭.৯৬%, প্রাণহানি ৬.৮৭% ঘটেছে।

যানবাহনভিত্তিক দুর্ঘটনার চিত্র:
পরিসংখ্যানে দেখা যায়- মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ১০৪ জন (৩৯.৬৯%), বাসযাত্রী ১১ জন (৪.১৯%), ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি আরোহী ১৫ জন (৫.৭২%), প্রাইভেটকার- মাইক্রোবাস-অ্যাম্বুলেন্স আরোহী ২৪ জন (৯.১৬%), থ্রি-হুইলার যাত্রী (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান- লেগুনা-টেম্পু) ৪৫ জন (১৭.১৭%), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-করিমন-ভটভটি-পাওয়ারটিলার) নয়জন (৩.৪৩%) এবং বাইসাইকেল আরোহী পাঁচজন (১.৯০%) নিহত হয়েছে।

মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা:
দুর্ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৪০.৯০%, মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে ২৭.২৭% এবং অন্য যানবাহন দ্বারা মোটরসাইকেলে চাপা/ধাক্কায় দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩১.৮১%। নিহতদের মধ্যে ২৮.৩৫ শতাংশের বয়স ১৩ থেকে ১৭ বছর। ৪৭.৭৬ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছর এবং ২৩.৮৮ শতাংশের বয়স ৩৬ থেকে ৬০ বছর।

সড়কের ধরন:
বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ৯৭টি (৩৮.৬৪%) জাতীয় মহাসড়কে, ৯১টি (৩৬.২৫%) আঞ্চলিক সড়কে, ২৮টি (১১.১৫%) গ্রামীণ সড়কে, ৩২টি (১২.৭৪%) শহরের সড়কে এবং ৩টি (১.১৯%) অন্যান্য স্থানে সংঘটিত হয়েছে।

দুর্ঘটনার ধরন:
দুর্ঘটনার মধ্যে ৬৪টি (২৫.৪৯%) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ১০৩টি (৪১.০৩%) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ৪৯টি (১৯.৫২%) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেওয়া, ২৭টি (১০.৭৫%) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ৮টি (৩.১৮%) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।

দুর্ঘটনার সময় বিশ্লেষণ:
পরিসংখ্যান বলছে- দুর্ঘটনাসমূহ ঘটেছে ভোরে ৬.৩৭%, সকালে ২৩.১০%, দুপুরে ২৭.৪৯%, বিকালে ১৭.১৩%, সন্ধ্যায় ৫.৫৭% এবং রাতে ২০.৩১%।

দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহন:
ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রাক্টর-ড্রামট্রাক-ট্রলি-কার্গো ট্রাক-ট্যাঙ্ক-লরি ১৮.৫৭%, যাত্রীবাহী বাস ১৩.৩২%, প্রাইভেটকার-মাইক্রোবাস-অ্যাম্বুলেন্স-জিপ ৭.৩১%, মোটরসাইকেল ২৫.৮৯%, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা-টেম্পু) ১৯.৮৮%, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন (নসিমন-করিমন-ভটভটি-মাহিন্দ্র-ঢালাই মেশিন গাড়ি-পাওয়ারটিলার) ৮.০৬%, বাইসাইকেল-প্যাডেল রিকশা ৩.৫৬% এবং অজ্ঞাত গাড়ি ৩.৩৭%।

দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা:
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা ৫৩৩টি। (বাস ৭১, ট্রাক ৫২, কাভার্ডভ্যান ১০, পিকআপ ১৩, ট্রাক্টর ৮, ড্রামট্রাক ৯, ট্রলি ৩, কার্গো ট্রাক ২, ট্যাঙ্ক লরি ২, মাইক্রোবাস ১৬, প্রাইভেটকার ১৮, অ্যাম্বুলেন্স ২, জীপ ৩, মোটরসাইকেল ১৩৮, থ্রি-হুইলার ১০৬ (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা-টেম্পু), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন ৪৩ (নসিমন-করিমন-ভটভটি-মাহিন্দ্র-ঢালাই মেশিন গাড়ি-পাওয়ারটিলার), বাইসাইকেল-প্যাডেল রিকশা ১৯ এবং অজ্ঞাত গাড়ি ১৮টি।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা: 
এবারের ঈদযাত্রায় মহাসড়কে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ভালো ছিল। দুর্ঘটনা কমানোর জন্য কিছু উদ্যোগ নেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবং বিআরটিএর চেয়ারম্যান। যদিও স্টেকহোল্ডারদের অসহযোগিতার কারণে এসব উদ্যোগের পুরোটা বাস্তবায়ন হয়নি, বিধায় প্রত্যাশিত ফলাফলও আসেনি।

যত লাখ মানুষের যাতায়াত:
এবার রাজধানী ঢাকা থেকে কমবেশি ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ ঘরমুখী যাত্রা করেছেন এবং প্রায় সাড়ে ৪ কোটি মানুষ আন্তঃজেলায় যাতায়াত করেছেন। উত্তরবঙ্গগামী সড়কের চন্দ্রা ও টাঙ্গাইলে যানজট হয়েছে। পদ্মাসেতুর টোল প্লাজায় এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কেও যানজট হয়েছে, তবে অসহনীয় মাত্রায় হয়নি। অনেক পরিবহন মালিক যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায় করেছে। বিআরটিএ এই ভাড়া নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ট্রেনে কিছুটা শিডিউল বিপর্যয় ঘটেছে। টিকিট কালোবাজারী হয়েছে। নৌ-পথে স্বস্তি থাকলেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়েছে। ঈদের ফিরতি যাত্রায় বাসে, লঞ্চে বাড়তি ভাড়া আদায়ের অভিযোগ রয়েছে।

সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান প্রধান কারণ:
এবারের ঈদ যাত্রায় দুর্ঘটনার প্রধান বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছে সংস্থাটি। এর মধ্যে রয়েছে-

১. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন।
২. বেপরোয়া গতি।
৩. চালকদের অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা।
৪. বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা।
৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল।
৬. বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালনা।
৭. জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা।
৮. দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা।
৯. বিআরটিএর সক্ষমতার ঘাটতি।
ও ১০. গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।

সুপারিশসমূহ:
দেশের সব জায়গায় সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর জন্য রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বেশকিছু সুপারিশও তুলে ধরেছে। এর মধ্যে রয়েছে-

১. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বাড়ানো।
২. চালকদের বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা।
৩. বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
৪. মালিক-শ্রমিক, যাত্রী-পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে এগুলোর জন্য সার্ভিস রোড তৈরি করা।
৬. পর্যায়ক্রমে সব মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করা।
৭. যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তির ব্যবহার করা।
৮. গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করা।
৯. রেল ও নৌপথ সংস্কার করে সড়ক পথের ওপর চাপ কমানো।
১০. গণপরিবহন উন্নত, সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করে মোটসাইকেল ব্যবহার নিরৎসাহিত করা।
১১. ঈদের আগে-পরে সড়ক, নৌ ও রেলপথে কঠোর মনিটরিং ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
১২. টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা।
১৩. ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করা।