এ দেশে এত মানুষ রাস্তায় মরে কেন?

প্রকাশিত: ১:২১ অপরাহ্ণ, জুলাই ১, ২০২৪

৩০ জুন ভোরের ঘটনা। খুবই মর্মান্তিক। এই ঘটনার প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম ‘ছেলের মরদেহ নিয়ে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল মায়েরও’। এই শিরোনামের সংবাদ যখন চোখে পড়ে, তখন বুঝতে বাকি থাকে না মানুষের জীবন কতটা অনিরাপদ। ঘর থেকে বের হয়ে আবার যে ঘরে ফিরে আসবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। গেল কোরবানি ঈদের ছুটিতে তিন শতাধিক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে চার শতাধিক ঘরমুখো মানুষ। আগের কোরবানি ঈদের চেয়ে এ সংখ্যা বেশি। কেন হচ্ছে এমন? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কে নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব যাদের, তাদের অযোগ্যতা ও দুর্বল পরিকল্পনার খেসারত দিতে হচ্ছে মানুষকে প্রাণ দিয়ে।

খবরটি থেকে জানা যায়, কলাপাড়ার ধানখালী ইউনিয়নের নিশানবাড়িয়া গন্ডামারি গ্রামের আলম হাওলাদার (৪৫) দীর্ঘদিন লিভার সিরোসিস রোগে ভুগছিলেন। গতকাল শনিবার রাতে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ (শেবাচিম) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ছেলে আলম হাওলাদারের মরদেহসহ মা পুষ্প বেগম আজ রোববার সকালে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে রওনা দেন বাড়ির উদ্দেশে। কিন্তু ঢাকা‑কুয়াকাটা মহাসড়কের বরগুনার আমতলী উপজেলার ডাক্তার বাড়ি এলাকায় পৌঁছালে, বিপরীত দিক থেকে আসা একটি মোটরসাইকেলের সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সটির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান মা পুষ্প বেগম ও মোটরসাইকেল চালক রুবেল সিকদার।

এই শোক সইবার ক্ষমতা কি নিহতের পরিবারের আছে? প্রিয়জন হারানোর বেদনা কি তারা মেনে নিতে পারবে? না, পারবে না।

সড়ক দুর্ঘটনা নৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে বললেও কম বলা হবে। প্রতিদিন দেশের কোনো না কোনো জায়গায় সংঘটিত হচ্ছে দুর্ঘটনা। এতে নবজাতক থেকে শুরু করে বৃদ্ধ, নানা বয়সী মানুষ মারা যাচ্ছে। সড়কে কার আগে কে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাবে এই নিয়ে চলে অসুস্থ প্রতিযোগিতা। আর এই প্রতিযোগিতার বলি হয় সাধারণ মানুষ। এর পর তারা খবর হয়ে আসে সংবাদমাধ্যমে।

দেশের সংবাদপত্র, টেলিভিশন, অনলাইনের চিরাচরিত শিরোনাম হচ্ছে ‘সড়ক দুর্ঘটনায়…জনের মৃত্যু’। এই শিরোনাম দেখতে দেখতে সকলেই যেন অভ্যস্ত হয়ে গেছে। সড়কে দুর্ঘটনায় অনেক বেশি মানুষের প্রাণহানি না ঘটলে তা তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। যদিও মৃতের সংখ্যা হিসেবে প্রচারিত সংখ্যাগুলো কোনো সংখ্যা শুধু নয়, একেকটি প্রাণের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতি। এখানে রয়েছে কারও বাবা‑মা, সন্তান, ভাই‑বোন বা স্বামী‑স্ত্রী। মৃত্যুতে থেমে যাচ্ছে সেসব পরিবারের স্বপ্ন। সড়কপথের একেকটি দুর্ঘটনার খেসারত কোনো কোনো পরিবারকে সারাজীবন বয়ে চলতে হয়। অনেক সময় অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয় যায় সেসব পরিবারগুলো।

কথার পিঠে কথা থাকে। প্রায়ই দেখা যায়, প্রশস্ত করা হচ্ছে সড়কপথ। দুর্ঘটনা কমানোর জন্য বিশেষ করে শহরাঞ্চলে বানানো হচ্ছে মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার, উড়ালসড়ক। এত কিছু তৈরির পর তো এ দেশের সড়কে মৃত্যু কমছে না কেন? বরং বাড়ছে।

বেশ কয়েকদিনের সড়ক দুর্ঘটনার কথা উল্লেখ না করে, শুধু দু‑একদিনের সড়ক দুর্ঘটনার হিসাবের দিকে তাকালেই এর মাত্রাটি বোঝা যাবে। গত ২৯ ও ২৮ জুন দেশের বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালে প্রকাশিত সংবাদে চোখ রাখা যাক—

৯ জুন

১. মুন্সিগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি উপজেলার বালিগাঁও বাজারে মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে যাত্রীবাহী বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে রুমাইসা নামের স্কুলছাত্রীর মৃত্যু হয়। নিহত রুমাইসা কিশোরগঞ্জ শহরের বত্রিশ এলাকার ফেরদৌস মিয়ার মেয়ে। সে স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণির ছাত্রী।

২. গাজীপুরের শ্রীপুরের মাওনা-কালিয়াকৈর সড়কের বদনীভাঙ্গা এলাকায় চাচার মৃত্যুর খবর শুনে বাড়ি যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় ভাতিজাসহ দুজনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় একজন আহত হয়েছেন।

৩. চুয়াডাঙ্গায় ইট বহনকারী ট্রলির চাকায় পিষ্ট হয়ে মুন্না হোসেন (১৭) নামের এক মোটরসাইকেল চালক নিহত হন। আলমডাঙ্গা উপজেলার খাসকররা বাজার এলাকায় এ দুর্ঘটনা হয়।

৪. ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড ফকিরহাট এলাকায় স্টার লাইন পরিবহনের একটি বাস উল্টে গেছে। এই ঘটনায় এক নারী নিহত হন। আহত হন অন্তত ১৬ জন।

২৮ জুন

১. ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নরসিংদীর রায়পুরায় পিকআপ, কাভার্ডভ্যান ও লেগুনার ত্রিমুখী সংঘর্ষে মো. বাচ্চু মিয়া (৩০) নামে এক চালক নিহত হন। এ সময় আহত হন চালকের সহকারী।

২. নেত্রকোণায় শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পথে ট্রাকের ধাক্কায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়ে নিহত হন সুজন বর্মণ নামের এক যুবক। এ সময় তাঁর স্ত্রীসহ তিন সহযাত্রী আহত হয়। নেত্রকোণা-মোহনগঞ্জ সড়কের সদর উপজেলার শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে এই দুর্ঘটনা হয়।

৩.কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে ট্রাক্টর‑মোটরসাইকেল মুখোমুখি সংঘর্ষে এক যুবক নিহত হন। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওই মোটরসাইকেলে থাকা আরও দুই যুবক। উপজেলার পৈলেনপুর মরাখলা এলাকায় সকালে এ ঘটনা ঘটে।

এখানে মাত্র দুদিনের দুর্ঘটনার খবর আছে। তাও শুধু সেসব দুর্ঘটনার খবরই আছে, যেখানে কেউ না কেউ নিহত হয়েছে। দেশে প্রতিদিন সড়কে বহু দুর্ঘটনা হচ্ছে, যেখানে কেউ নিহত না হলেও গুরুতর আহত হচ্ছে, যার ফল হিসেবে বরণ করতে হচ্ছে পঙ্গুত্ব। এসবের মধ্যে বড় কোনো সড়ক দুর্ঘটনা হলে বেশ আলোড়ন হয়। তখন আবার সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে নানা আলোচনা শুরু হয়।

সড়কের নিরাপত্তা বাড়াতে নানা সময়ে নানা টোটকা হাজির হতে দেখা যায়। কখনো কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে, কখনো বিশেষজ্ঞদের তরফ থেকে। কিন্তু কোনো সুরাহা মেলে না। বারবার করে বলা হয়—সড়কে মৃঙ্খলা ফেরাতে হবে। কিন্তু সেই সোনার পাথরবাটির দেখা আর মেলে না।

অথচ কে না জানে যে, সড়কে এই মৃত্যু কমাতে সড়ক ব্যবস্থাপনায় আনা প্রয়োজন শৃঙ্খলা। সড়কে গণপরিবহন চলাচলে শৃঙ্খলা আনতে প্রয়োজন যৌক্তিক ‘রুট পারমিট’, তদারকি ইত্যাদি।