রোমান-দিয়া কি কিছু পাননি?

প্রকাশিত: ১২:০৮ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৯, ২০২৫

‘দেশের জন্য এত কিছু করলাম, দেশ আমাকে কি দিল?’- আর্চার রোমান সানার কণ্ঠে এমন আক্ষেপ ঝরত মাঝেমধ্যেই। গত বছর আর্চারি জাতীয় দল থেকে হুট করেই অবসরের ঘোষণা দিয়ে বসেন। খবরের কাগজকে সে সময় বলেছিলেন, ‘আমরা তো ভালো সুযোগ-সুবিধা, একটু উজ্জ্বল বভিষ্যতের জন্য খেলাধুলায় আসি। যে যার জায়গা থেকে সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করি। কিন্তু সেটা করেও যদি কিছু না পাই, তখন কি বলার থাকে? আপনি চিন্তা করেন, আমি ওয়ার্ল্ড কাপ, ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ, এশিয়া কাপে পদক পেয়েছি। অথচ সরকার থেকে না কোনো ফ্ল্যাট, না কোনো বাড়ি, কোনো কিছুই পাইনি। আমি আর কত রেজাল্ট করব বলেন? এত বড় খেলোয়াড় হয়ে যদি স্ত্রীর খরচটাই চালাতে না পারি, তাহলে এর থেকে কষ্টের কী থাকে।’

এসব আক্ষেপের গান গাইতে গাইতে সম্প্রতি রোমান সানা হুট করেই পাড়ি জমিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে। সঙ্গে নিয়ে গেছেন আরেক তারকা আর্চার স্ত্রী দিয়া সিদ্দিকীকেও। তারা দুজনই ২০২০ টোকিও অলিম্পিকে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। সংশ্লিষ্ট কাউকে কিছু না জানিয়ে তাদের হুট করে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেওয়া ক্রীড়াঙ্গনে এই মুহূর্তে অন্যতম আলোচিত ঘটনা। রোমান সানা কয়েকটি সংবাদমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন, উন্নত জীবনের সন্ধানেই তারা যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। সেখানেই স্থায়ী হতে চান।

রোমান-দিয়া যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন আর্চারির কল্যাণে পাওয়া ভিসাকে কাজে লাগিয়ে। অর্থাৎ আর্চারি খেলার কারণেই এখন মার্কিন মুলুকে উন্নত জীবনের সন্ধানে তারা। কিন্তু দেশের আর্চারি নিয়ে রোমানের কণ্ঠে কেবলই বিষোদগার। যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেওয়ার পর একটি সংবাদমাধ্যমকে যেমন বলেছেন, ‘সত্যি কথা বলতে কী বাংলাদেশে কোনো ভবিষ্যৎ নেই। উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় আমরা যুক্তরাষ্ট্রে এসেছি। আর টাকা ছাড়া কোনো মূল্য নেই। আর্চারি খেলে বাংলাদেশের জন্য যা কিছু করেছি, সেগুলো তো কেউ মনে রাখেনি।

আপনি বলেন– এত পদক এনে দিলাম, সাফল্য এনে দেওয়ার পরও দিন শেষে কী পেয়েছি? কিছুই পাইনি। পেয়েছি অপমান, বঞ্চনা। লাঞ্ছনার শিকার হয়েছি।’ ফেডারেশনের ওপরই যত ক্ষোভ তার, ‘ফেডারেশনকে কেন বলতে যাব। তারা আমাদের কী দিয়েছে। বাংলাদেশে আর্চারি খেলে কী পেয়েছি? ফেডারেশনই বা আমাদের জন্য কী করেছে। সেখানে কিছু নেই বলেই তো আমরা আজকে এখানে এসেছি।’

কিন্তু রোমান সানাদের জন্য আসলেই কি কিছুই করেনি ফেডারেশন? খুলনার তরুণ রোমান সানাকে আর্চার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে ফেডারেশনই। এমনকি তিনিই এখন পর্যন্ত ফেডারেশন থেকে সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্ত খেলোয়াড়। একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে, অলিম্পিক স্কলারশিপ, পারফরম্যান্স ইনসেনটিভ, পকেট ভাতা ও অন্যান্য বাবদ ২০১৮ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ফেডারেশন থেকে ৪৬ লাখ ৬০ হাজার ৭৭০ টাকা পেয়েছেন রোমান। এ ছাড়া আর্চার হিসেবে তিনি বাংলাদেশ আনসারেও যুক্ত ছিলেন। আনসার থেকেও তিনি নির্দিষ্ট অঙ্কের মাসিক ভাতা পেতেন। সেই অঙ্কটাও নেহাত খারাপ ছিল না। এই আর্চারি খেলে খুলনায় তিনি বাড়িও করেছেন।

রোমানের স্ত্রী দিয়া সিদ্দিকী অলিম্পিক স্কলারশিপ, পারফরম্যান্স ইনসেনটিভ,পকেটভাতা ও অন্যান্য বাবদ ২০১৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ফেডারেশন থেকে পেয়েছেন ২৩ লাখ ৬২ হাজার ৯৯৩ টাকা। বিকেএসপি থেকে এসএসসি, এইচএসসি শেষে খেলোয়াড় কোটায় তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অর্থাৎ খেলোয়াড়ি জীবনের বাইরেও তার সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগ ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেওয়া আরেক আর্চার হাকিম আহমেদ রুবেল ২০২২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ২৩ লাখ ১০ হাজার ৮৩৭ টাকা পেয়েছেন ফেডারেশন থেকে।

বাংলাদেশে ক্রিকেট এবং ফুটবলের কথা বাদ দিলে অন্য সব খেলার আর্থিক ভিত্তি মজবুত নয়। এই আর্থিক অনিশ্চয়তা ভালো খেলোয়াড় তৈরি ও ফলাফলে বড় অন্তরায়। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ফেডারেশনগুলোরও রয়েছে সীমাবদ্ধতা। এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গত এক দশকে দেশের আর্চারি এগিয়ে গেছে অনেকটাই। ক্রিকেট-ফুটবলের পর এখন দেশের সবচেয়ে আলোচিত খেলাটার নাম আর্চারি। আর সেই আর্চারির ‘পোস্টারবয়’ হয়ে উঠেছিলেন রোমান সানা। পোস্টার গার্ল দিয়া সিদ্দিকী। রুবেলও ছিলেন দারুণ সম্ভাবনাময় এক আর্চার। কিন্তু তিনজনই এখন দেশান্তরী। তাদের তিনজনের আগে আরেক আর্চার অসীম কুমার যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন। সবার যাওয়ার প্রক্রিয়া একই। ২০২১ সালে আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্র গিয়েছিলেন তারা। সেই ভিসাটাই কাজে লাগিয়েছেন এই খেলোয়াড়রা।

রোমান সানার কথা আরও বিশেষ করে বলতেই হয়। তারকা তকমা পাওয়ার পর রোমান সানা যেন কেবলই আকাশে উড়তে চেয়েছেন। ক্যাম্প চলাকালে গুরুতর শৃঙ্খলাভঙের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন। পেয়েছেন শাস্তি। পারফরম্যান্স শুধু তলানির দিকে গেছে। অন্যদিকে মুখে কেবলই বলে গেছেন না পাওয়ার হাহাকার-বঞ্চনার কথা।

রোমান সানা এসব বলতেন ক্রিকেটারদের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করে। ক্রিকেটাররা তাদের চেয়ে অনেক বেশি পারিশ্রমিক পান, এটা মোটেও মানতে পারতেন না তিনি। অথচ বাংলাদেশের ক্রিকেট যে একদিনে এতদূর যায়নি, সেটা তাকে কে বোঝাবে? বাংলাদেশের ক্রিকেটাররাও যে এক সময় খুব বেশি কিছু পেতেন না, সেটাই বা কে বলবে? অন্য অনেককে সঙ্গে নিয়ে পারফরম্যান্সের ডানা মেলে দেশের আর্চারিকে ক্রিকেটের কাতারে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারতেন রোমান সানা, কিন্তু সেদিকে মন দেননি তিনি। কি পেলাম কি পেলাম করে করে, আর্চারি থেকে অনেক কিছু নিয়ে এখন ঝলমলে দুনিয়ার স্বপ্নে বিভোর তিনি!

এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য রোমান সানার হোয়াটসঅ্যাপ-ম্যাসেঞ্জারে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি। সাড়া দেননি দিয়া সিদ্দিকীও।