বিস্তর দাবি, বাস্তবতা ভিন্ন

প্রকাশিত: ১২:৪৬ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৩০, ২০২৫

দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই টানা আন্দোলন, কর্মসূচি ও দাবির মুখে অন্তর্বর্তী সরকার। প্রশাসনিক দায়িত্ব আর দাবিদাওয়া নিয়ে সৃষ্ট পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে সমান্তরালভাবে। মধ্যরাতেও সড়কে অবস্থানকারীদের কাছে হাজির হতে হচ্ছে উপদেষ্টাদের। জিম্মি করেও দাবি আদায়ের চেষ্টা চলছে। ফলে ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হচ্ছে নগরীর বাসিন্দাদের। আর এসব দাবিদাওয়ার বড় অংশই আর্থিক। তাই সব পক্ষের দাবি মানতে গেলে বাজেটের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়তে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ পরিস্থিতিতে শত শত দাবি মেনে নেওয়ার সক্ষমতা রাষ্ট্রের আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. দিল রওশন আরা জিন্নাত আরা নাজনীন খবরের কাগজকে বলেন, অনেক ক্ষেত্রে দাবিগুলো যৌক্তিক। বহু দিন ধরে সুযোগ-সুবিধা পায়নি মানুষ। তাদের তো নাভিশ্বাস উঠে গেছে। দীর্ঘ ১৭ বছর তো মানুষ সেভাবে দাবি জানাতে পারেনি।

তিনি বলেন, সরকারের দিক থেকে যদি দেখি, আর্থিক অবস্থা খারাপ ছিল। ড. ইউনূসের সরকার ভালো করার চেষ্টা করছে। বড় ধরনের পরিবর্তনের কারণে সবার প্রত্যাশা বেড়েছে। এ জন্য দাবিদাওয়ার বহর বেড়েছে। রাষ্ট্রকে বুঝে বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোথায় কতটুকু কী করা যায়। আশ্বাস না দিয়েও উপায় নেই। পুরোটা না পারলেও কিছুটা করলে তারা একটু হ্যাপি থাকবে।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলে ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর থেকেই তাদের বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন সামাল দিতে হচ্ছে। এসব কর্মসূচির কারণে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয় পর্যন্ত অবরুদ্ধ ছিল। খবরের কাগজের নিজস্ব হিসাব অনুযায়ী, সরকারের প্রথম ৪৬ দিনে ঢাকা শহরে ৬৪টি সংগঠনের পক্ষ থেকে ৩৬০টি দাবি উত্থাপন করা হয়। দেশের অন্য বিভাগীয় শহরগুলো বিবেচনায় নিলে দাবির সংখ্যা হাজারের বেশি। অন্য এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দাবি আদায়ে ১৩৬টি বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়েছে রাজধানীতে।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, এসব দাবির দুটি দিক রয়েছে। প্রথমত, সংক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর বিভিন্ন দাবিদাওয়া, যেমন: আইন প্রণয়ন করা, হামলার বিচার, পরীক্ষা বাতিল, অটোপাস, পদত্যাগের দাবি। দ্বিতীয়ত, সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থেকে আন্দোলন। এই দিক থেকে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে শুরু নিম্ন স্তরের কেউ বাদ যাননি। সরকার গঠনের শুরুর দিকে নিজেদের আওয়ামী লীগ আমলে বঞ্চিত দাবি করে পদোন্নতির দাবিতে বিক্ষোভ করেন সচিবালয়ে কর্মরত বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা। সরকার তাদের মধ্য থেকে ১১৭ জনকে উপসচিব এবং ২০১ জনকে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি দেয়। পদোন্নতির ফলে তাদের পেছনে রাষ্ট্রের ব্যয় বেড়েছে।

ট্রেইনি চিকিৎসকরাও তাদের ভাতা বৃদ্ধির জন্য আন্দোলনে নামে। শাহবাগ এলাকায় অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন তারা। দাবির মুখে সরকার তাদের ভাতা ৫ হাজার টাকা বৃদ্ধি করে। কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করে ৫০ হাজার টাকা করার দাবি জানান। পরে সরকার আরও ৫ হাজার টাকা বৃদ্ধি করে ৩৫ হাজার টাকা করেন। সারা দেশে ট্রেইনি চিকিৎসকের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। সে হিসাবে রাষ্ট্রের অতিরিক্ত খরচ হবে প্রতি মাসে ১০ কোটি টাকা।
সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারাও তাদের বেতন গ্রেড পরিবর্তনের দাবিতে আন্দোলন করেন। অডিট বিভাগের কর্মকর্তারা তাদের দশম গ্রেডের জন্য অবরোধ কর্মসূচিও পালন করেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কর্মকর্তারা পদোন্নতির দাবিতে আন্দোলন করেছেন। কর্তৃপক্ষও তাদের বিধি না মেনে পদোন্নতি দেয়। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকে ৭ হাজার ২১৫ জনকে পদ না থাকলেও পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এতে বেড়েছে ব্যয়।

সরকারি কর্মকর্তাদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার সুপারিশ কার্যকর হলে অতিরিক্ত ৭ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। এটি আপাতত স্থগিত আছে। সর্বশেষ রেলের কর্মচারীরাও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার দাবিতে আন্দোলন করেন। কর্মসূচির কারণে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। পরে সরকার তাদের ওভারটাইমসংক্রান্ত দাবি মেনে নেয়।

আশ্বাস দিয়ে সামালের চেষ্টা 
বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলনরতদের আশ্বাস দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টায় সরকার। কয়েক দিন ধরে আন্দোলনরত ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকদের জাতীয়করণের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। এই জাতীয়করণ হলেও রাষ্ট্রের ব্যয় বাড়বে। যদিও তাদের দাবিকে যৌক্তিক বলছেন শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা।

আর্থিক সম্পর্ক ছাড়া দাবির বিষয়েও সরকারকে আশ্বাস দিতে হচ্ছে। সরকারি সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিও এর মধ্যে একটি। হুটহাট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুযোগ না থাকায় সরকার বিভিন্ন কমিটি গঠনের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় রয়েছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।

অন্যদিকে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি নিয়ে মহাখালীতে অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। সরকার এখানেও কমিটি গঠন করে। তা না মেনে তারা দফায় দফায় আলটিমেটাম দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন, ট্রাস্টি বোর্ডের অনিয়ম নিয়ে ইউজিসি, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ঘেরাও করার মতো কর্মসূচি পালন করছেন পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ ইস্যু নিয়েও জটিল পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বহিরাগত যান নিয়ন্ত্রণ নিয়েও অন্যরা সমালোচনা করছেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের কাজ সেনাবাহিনীকে দেওয়ার জন্য সচিবালয়ের সামনে অবস্থান করেন। সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও ব্যাটারিচালিত রিকশাচালকরাও কয়েক দফা কর্মসূচি পালন করেন। তারা ঢাকার বিভিন্ন মোড় অবরোধ করে কর্মসূচি পালন করেন। বাদ যাননি প্যাডেলচালিত রিকশার চালকরাও।

চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিতেও বেশ কয়েক দফা কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনেও অবস্থান কর্মসূচি পালন করা হয়। পোশাকশ্রমিকরা সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর দাবিতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় কর্মসূচি পালন করেন। এসব কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণে অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসন বলপ্রয়োগ করে। আবার আন্দোলনরতরাও ভাঙচুর করেন। সরকারের শুরুর দিকে নিরাপত্তার দাবিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজনও ব্যাপক কর্মসূচি পালন করেন।

সামনে আসছে আরও দাবিদাওয়া
বিশেষ পরিস্থিতির কারণে সবার প্রত্যাশা বেড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা এই সময়ে দাবি আদায়ের জন্য পরিকল্পনা করছেন। সরকার ইবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষকদের দাবির বিষয়ে আশ্বাস দিলে অন্যরাও মাঠে নামার পরিকল্পনা করছেন। স্বীকৃতিপ্রাপ্ত সব নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একযোগে এমপিওভুক্তির জন্য ১২ ফেব্রুয়ারি লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালন করবে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ভ্যাট প্রত্যাহারের জন্য কর্মসূচি পালন করতে পারে বলে জানা গেছে।

বিশ্লেষকদের মতে, স্বাধীনতার পর থেকে এত কম সময়ে সরকারের কাছে এত দাবিদাওয়া উত্থাপিত হয়নি। অন্যদিকে সরকারের পক্ষে এত দাবি মানাও অসম্ভব মনে করছেন তারা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সবার দাবিদাওয়া পূরণ করতে হলে বড় অঙ্কের বাজেট দরকার। এ রকম সুযোগ-সুবিধার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হলে বাজেটের ওপর চাপ পড়বে।