বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস আজ বিলুপ্ত হচ্ছে মেছোবাঘ, গন্ধগোকুল

প্রকাশিত: ১১:৪৩ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ৩, ২০২৫

২০২৪ সালের ১৩ নভেম্বর ঝিনাইদহের শৈলকুপায় একটি মেছোবাঘ কৃষকের গোয়ালঘরে ঢুকে দুটি ছাগল মেরে ফেলে। পরের রাতে আবার এসে মুরগির ঘরে ঢোকে মেছোবাঘটি। ওই সময় বাড়ির লোকজন টের পেয়ে ধাওয়া করলে পাশে রাখা একটি জালে আটকা পড়ে বাঘটি। পরে গ্রামবাসী মেছোবাঘটিকে পিটিয়ে হত্যা করে।

একইভাবে চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরে আরেকটি মেছোবাঘ হত্যা করে গ্রামবাসী। পরে তার ছবি ফেসবুকে দিলে মুহূর্তে ভাইরাল হয়। এ ঘটনায় কোটচাঁদপুর সামাজিক বনায়ন নার্সারি ও প্রশিক্ষণকেন্দ্রের কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন।

জানা যায়, গত এক বছরে খুলনা বিভাগের মধ্যে ঝিনাইদহে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক হারে মেছোবাঘ হত্যার ঘটনা ঘটেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, জনসচেতনতার অভাবে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে।

খুলনা বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় এভাবে পৃথিবী থেকে নানা প্রজাতির প্রাণী ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। বিলুপ্তপ্রায় এসব প্রাণীকে রক্ষা করতে সারা বিশ্বে প্রতি বছর ৩ মার্চ বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস পালন করা হয়। এ বছর আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস’ খুলনা বিভাগের ঝিনাইদহে পালন করা হবে। সেই সঙ্গে সেখানে মেছোবাঘ রক্ষায় স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য ও সাধারণ মানুষ নিয়ে সচেতনতা সভার আয়োজন করা হচ্ছে।

ঝিনাইদহ সামাজিক বনায়ন ও নার্সারি কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন বলেন, এই অঞ্চলে মেছোবাঘের পাশাপাশি গন্ধগোকুল, শিয়াল, বেজি, গুইসাপ ও খরগোশ বিপন্ন বন্যপ্রাণীর তালিকায় রয়েছে। প্রায়ই কোনো না কোনো গ্রামে এসব প্রাণীকে আটকের পর হত্যা করা হয়।

২০২৪ সালের ২০ মে কুষ্টিয়ার মিরপুরে একটি বিলুপ্তপ্রায় গন্ধগোকুল ফল খাওয়ার জন্য লিচুবাগানে গেলে জালে আটকা পড়ে। প্রাণীটিকে বাঁশের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়। এতে তার পেছনের দুই পা আঘাতপ্রাপ্ত হয়। পরে আহত অবস্থায় গন্ধগোকুলটি উদ্ধার করা হয়। এসব কারণে ৩ মার্চ সারা দেশে বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস পালনের পর ৮ মার্চ ঝিনাইদহে আলাদাভাবে দিবসটি পালন করা হবে। ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বন্যপ্রাণী রক্ষায় জনসচেতনতামূলক সভার আয়োজন করা হয়েছে।

জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের জন্য মানুষ হরহামেশাই বন উজাড় করে দিচ্ছে। এতে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে অনেক বন্যপ্রাণী। এ ছাড়া প্রাকৃতিকভাবে নানা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে এরই মধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে অনেক বন্যপ্রাণী। জাতিসংঘের তথ্যমতে, সারা পৃথিবীতে বর্তমানে বন্যপ্রাণী বিলুপ্তির হার আগের তুলনায় বেড়েছে। প্রকৃতি সংরক্ষণ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএনের গবেষণা মতে, বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত প্রজাতির প্রাণীর সংখ্যা ৩১টির মতো। তবে এ সংস্থাটির দাবি, বাংলাদেশে ১ হাজার ৬০০-এর বেশি প্রজাতির প্রাণী রয়েছে। যার মধ্যে ৩৯০টি একেবারে শেষ হওয়ার পথে। ২০২৪ সালে সবচেয়ে বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে আমুর চিতাবাঘ, গন্ডার, ওরাং-ওটাং, গরিলা, সাওলা, সুন্দা বাঘ, ইয়াংজি ফিনলেস পোরপোইস, কচ্ছপ ও হাতি। এ ছাড়া এ রকম আরও অসংখ্য প্রাণী আছে, যারা বিলুপ্ত হয়ে গেছে, না হয় খুবই স্বল্পসংখ্যক বেঁচে আছে।

এদিকে বন কর্মকর্তারা জানান, সবসময় যে মেছোবাঘকে হত্যা করা হয়েছে, বিষয়টি এমন নয়। ২০২৩ সালের ২৩ জানুয়ারি ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু এলাকায় ফাঁদ পেতে শাবকসহ একটি মেছোবাঘ আটক করে গ্রামবাসী। স্থানীয়রা জানান, কয়েক দিন ধরে সন্ধ্যার পর মাঠের পাশে অপরিচিত প্রাণীর ডাকাডাকির শব্দ শোনা যাচ্ছিল। ফাঁদ পাতা হলে মেছোবাঘ ও শাবকটি ধরা পড়ে। পরে বন বিভাগের কর্মকর্তারা নির্জন জায়গায় সেগুলো অবমুক্ত করেন।

তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, নানামুখী চ্যালেঞ্জের পরও কিছু এলাকায় বন্যপ্রাণীর সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইইউসিএনের গবেষণা মতে, সুন্দরবনে বাঘের খাদ্য চিত্রা হরিণ ও বন্য শূকর আগের তুলনায় বেড়েছে। গবেষণায় ২০২২ সালে বনে চিত্রা হরিণ দেখা যায় ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬০৪টি। যা ২০০৪ সালে ছিল প্রায় ৮৩ হাজার। ২০২২ সালে বন্য শূকর ছিল ৪৭ হাজার ৫১৫টি। যা ২০০৪ সালে ছিল প্রায় ২৮ হাজার। ২০২২ সালে ছোট লেজওয়ালা বানর ছিল ১ লাখ ৫২ হাজার ৪৪৪টি। যা ২০০৪ সালে ছিল প্রায় ৫১ হাজার। এ ছাড়া টিকটিকি জাতীয় প্রাণী আছে ২৫ হাজার ১২৪টি ও শজারু আছে ১২ হাজার ২৪১টি।

বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা নির্মল কুমার পাল বলেন, এ অঞ্চলের ২১টি জেলার মধ্যে ঝিনাইদহে সবচেয়ে বেশি মেছোবাঘ হত্যার ঘটনা ঘটে। গত ৬ মাসে সেখানে মেছোবাঘ হত্যার পর তা প্রদর্শনের ঘটনায় দুটি মামলা করতে হয়েছে। এ কারণে যেসব বন্যপ্রাণী ঝুঁকির মধ্যে আছে সেগুলো রক্ষায় বন্যপ্রাণী দিবসে সচেতনতা বৃদ্ধিসহ বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর জাতিসংঘের ৬৮তম সাধারণ অধিবেশনে ৩ মার্চ ‘বিশ্ব বন্যপ্রাণী দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০১৪ সালে প্রথম এ দিবসটি পালন করা হয়। বিশ্বের বন্যপ্রাণীর প্রতি গণসচেতনা বাড়ানোই এ দিবসের মূল লক্ষ্য।