ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা

প্রকাশিত: ২:৩৬ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৩, ২০২৪

ধান ভানতে শিবের গীত

‘আমাকে শনাক্ত করো হে যৌবন, যুদ্ধের সন্তান,
আমাকে শনাক্ত করো স্বদেশের দগ্ধ কৃষ্ণচূড়া।’

সত্যজিৎ রায়ের ‘অশনি সংকেত’ হলে বসে দেখা আমার প্রথম সিনেমা, আমি তখন সদ্য ১১। হলদিবাড়ি, দেশভাগের পর অন্যদেশ হয়ে যাওয়া আমারই বাংলার সঙ্গে এই ভারতের সীমান্তের অন্তিম রেল স্টেশন। স্টেশন থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরেই কালো কাঁটাতারের সীমান্ত। কাঁটাতারে হাতে হাত ধরে এপ্রান্ত ওপ্রান্ত মানুষের থেকে উঁচু লোহার স্তম্ভ, সেই কালো কাঁটাতার। কয়েক মিটার পর পর মাথা বাঁকানো সেই পিলারগুলোকে আধো-অন্ধকারে অনেকটা শহিদ বেদির ভাস্কর্য মনে হয়। সেই আমার প্রথম সীমান্ত দেখা, এ পারে বাংলা, ও পারে বাংলাদেশ।

১৯৭৪ সালের সেই মাঘ মাস, সেই শীতকাল। এর পরের প্রবল গ্রীষ্ম দিনে দেশে অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। মাঝে বসন্ত এলো, বাসন্তী দোল। ফাল্গুন মাস, দোলযাত্রা, রং খেলা, হোলি। শীত কমে আসছে, বাতাসের তাপ বাড়ছে। সেই সময় আমাদের হোলি-প্রস্তুতি শুরু হতো বাসন্তী বা দোল পূর্ণিমার কয়েকদিন আগে থেকেই। মানিকের এক মামাতো দাদা এসে সেবার আমাদের সেবার দোলের প্রস্তুতিতে হাত লাগালেন। কাটা সুপারির দ্বিখণ্ডিত শুকনো খোল সংগ্রহ করে আনা হলো। মোম গলিয়ে সেই গরম তরল সুপারির খোলের ভেতর ভরে সেটা বন্ধ করে ভালো করে ঝাঁকিয়ে সতর্কভাবে রাখা হতো। ঠান্ডা হয়ে গেলে আরো সতর্কভাবে সেই সুপারির খোল খোলা হতো। ভেতরে ছোট্ট বলের মতো সুপারির আকারের মোমের বল তৈরি হতো। একটা ইঞ্জেকশনের সুচ দিয়ে জলে গোলানো রং তাতে ভরে আমাদের ‘রং গুলি’ তৈরি হলো। এই ‘রঙের গুলি’ অনেক দূর থেকেও কারো শরীর লক্ষ্য করে ছুড়ে তাকে রং ছিটিয়ে ঘায়েল করা যেত। বন্দুকের গুলির মতো সেই মোমগুলি ভেঙে জামার উপর রং ছিটিয়ে দিত। আমাদের উল্লাস ও আক্রান্তের ভ্যাবাচ্যাকা রাগ, জমে উঠতো আমাদের রঙখেলার মজা। বাঁশ দিয়ে বানানো পিচকারির থেকে গোলাপি আবিরেই আমার টান ছিল বেশি। দ্বিতীয় দিন পিচকারি, রঙ-গুলি, প্রথমদিন শুধু আবির খেলা শুরু হতো বড়দের পায়ে আবির দিয়ে। সমবয়সীরা দল বেঁধে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরতাম, দাদাদের মধ্যে চুপিচুপি ভাঙের শরবত খাওয়ার চল থাকলেও আমাদের জন্য বরাদ্দ ছিল লাড্ডু। খেলায় শেষ হতো কাদা খেলায়, এরপর কলোনির পুকুরে সবাই মিলে স্নানে। কলোনির কয়েকটি বাড়িতে ‘ঝুলন’ হতো। তিন নম্বর গলির গোস্বামী বাড়িতে উঠানের একদিকে দোলনায় ঝোলানো থাকতো গোপাল। তকে আবির মাখানো হতো। এই বাড়ির বড় মেয়ে মধুমিতা ব্যডমিন্টনে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। মায়ের কাছে এই ঝুলনের গল্প শুনতাম। রাধাকৃষ্ণের প্রেম আনন্দের এই রঙিন উদ্‌যাপন। ব্রজে বা মথুরায় অর্থাৎ কৃষ্ণের শৈশব ও কৈশরের ভূমিতে রঙ-প্রথা পালিত হয় রং খেলার মধ্য দিয়ে। কৃষ্ণবর্ণ চেহারা ছিল কৃষ্ণের। পুতনার বিষ মাখানো স্তনের দুধ পানের প্রকোপেই হোক বা ‘নারায়ণের অবতার’ রূপেই হোক তার নামের সঙ্গে, কৃষ্ণকথার অংশ হয়ে গিয়েছে এই গাত্রবর্ণ। সে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে ‘হোলি’ খেলায় মাতোয়ারা হতো। গৌড়বর্ণা রাধা ও তার সখীদের আবির কুমকুমে রাঙিয়ে দিতো কৃষ্ণবর্ণ কৃষ্ণ ও তার সাথীরা।  এই গাত্রবর্ণ প্রসঙ্গে মনে পড়ে, ১৯৯১ নাগাদ মালদহে এক সাহিত্য আলোচনায় উদ্বোধনে এসে ‘রাজনগর’ স্রষ্টা অমিয়ভূষণ মজুমদার বলেছিলেন, কৃষ্ণের বা রামের গাত্রবর্ণ কালো, এটা প্রতীকী। এই কৃষ্ণবর্ণ আসলে সমাজের প্রান্তিক, শূদ্র জনতার আধিপত্যের প্রতীকী প্রতিনিধিত্ব। উঠে দাঁড়িয়ে ‘একটা পুঁচকে ছোকরা’ এই কথার প্রতিবাদ করায় সেবার বেশ শোরগোল পড়ে যায়। আমি সেই সময় ও আজও এই ব্যাখ্যার বিপ্রতীপে আছি। বর্ণবাদী সমাজের ডিসকোর্স এতো সরলীকরণ মেনে চলে না। ব্রাহ্মণ্যবাদ নির্মিত সাহিত্য তো নয়ই।