আদালতপাড়ায় ভোগান্তির শেষ কবে?

প্রকাশিত: ৮:০৯ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৩০, ২০২৪

ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে নতুন নতুন আসামি ও বিচারপ্রার্থীও বেড়েছে, কিন্তু ঢাকার আদালতপাড়ার ভোগান্তির চিত্র খুব একটা বদলায়নি।

যেখানে হাজার হাজার লোকের আসা যাওয়া সেই জেলা জজ আদালত, মহানগর দায়রা জজ আদালত, মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত ও মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে বিচারপ্রার্থীদের বসার ব্যবস্থা নেই।

দূর-দূরান্ত থেকে যারা বিচারের জন্য আসেন, দিনভর তাদের অপেক্ষা করতে হয় আদালত চত্বরে, গাছতলা কিংবা ফুটপাতে।

এছাড়া প্রত্যেক এজলাসের বাইরে বসার জন্য পর্যাপ্ত বেঞ্চ নেই। কিছু জায়গায় বসার বেঞ্চ থাকলেও সেগুলো ভেঙে গেছে। তাই বিচারপ্রার্থীদের বারান্দাতেই দাঁড়িয়ে বা বসে থাকতে হয়। তাদের জন্য নেই শৌচাগারের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা।

নারী ও শিশু বিচারপ্রার্থীদের জন্য রেবতী ম্যানসনে একটি বিশ্রামাগার থাকলেও সেখানে স্বল্পসংখ্যক লোকের জন্য ব্যবস্থা রয়েছে। ন্যায়কুঞ্জ নামে আরেকটি বিশ্রামাগার করা হয়েছে। মাসখানেক আগে উদ্বোধন হলেও এটি এখনো চালু করা হয়নি।

আল আমিন নামের এক বিচারপ্রার্থী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আদালতে বিচারপ্রার্থীদের জন্য একটু বসার সুযোগ নেই। আদালতে বিচার চাইতে আসা আরেক ভোগান্তি। এজলাসে আইনজীবীদের বসার ব্যবস্থা আছে, কিন্তু বিচারপ্রার্থীদের বসার জায়গা নেই।”

এসব সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় জায়গার সংকটের কথা বলছেন আদালতের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও আইনজীবীরা। তারা বলেছেন, এর মধ্যে থেকে যেসব সমস্যা সমাধান করা যায় সেগুলো করার চেষ্টা করছেন তারা।

ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নাজির আমিনুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে ক্যাফে থাকবে তাই আমরা টয়লেট রাখিনি। এখানে বিচারপ্রার্থীরা খাওয়া দাওয়া করবে টয়লেট থাকলে দুর্গন্ধ ছড়াবে। তবে ন্যায়কুঞ্জের আসা বিচারপ্রার্থীদের জন্য জেলা জজ আদালতের পশ্চিম পাশে আধুনিক টয়লেট করা হবে।”

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি ওমর ফারুক ফারুকী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিচারপ্রার্থীদের জন্য ন্যায়কুঞ্জ উদ্বোধন করা হয়েছে। এখন কোর্ট বন্ধ আছে তাই খোলা হচ্ছে না হয়ত। জানুয়ারির ১ তারিখ থেকেই খোলা থাকবে।

ডিসেম্বরের পুরো মাস ছুটির পর ন্যায়কুঞ্জ চালু করার কথা বলা হলও এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পশ্চিমপ্রান্তে রেবতী ম্যানসনে বর্তমানে আটটি এজলাস, মহানগর দায়রা জজ, জেলা ও দায়রা জজ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের পাবলিক প্রসিকিউটরের কার্যালয় রয়েছে।

এখানে নারী ও শিশু বিচার প্রার্থীদের জন্য একটি বিশ্রামাগার রয়েছে। বিশ্রামাগারে দুইটি শৌচাগার আর শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর (ব্রেস্ট ফ্রিডিং) ব্যবস্থা আছে। একসঙ্গে বিশ্রাম নিতে পারে ১০ থেকে ১৫ জন।

এদিকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের নাজির রেজোয়ান খন্দকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা ২৪ ডিসেম্বর এখানকার প্রত্যেকটি আদালতে একটি করে প্লাস্টিকের বেঞ্চ দিয়েছি বিচারপ্রার্থীদের জন্য। দেশের আর কোথাও বিচারপ্রার্থীদের বসার জায়গা নেই। আমরা চালু করেছি।”

এই বেঞ্চ বিচারপ্রার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত কি না, এই প্রশ্নে তিনি বলেন, “এত মানুষের ব্যবস্থা করা তো সম্ভব না। আমাদের জায়গা কম। সিএমএম আদালতে অন্যান্য আদালতের থেকে বেশি মানুষ আসে। সেই তুলনায় আদালতের জায়গা কম। সিএমএম আদালতের জন্য আরো বেশি জায়গা প্রয়োজন।”

উন্মুক্ত স্থানে মাদক পোড়ানোতে অস্বস্তি

মামলার আলামত হিসেবে জব্দ করা গাঁজা, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন মাদক ঢাকার মুখ্য মহানগর আদালত ও মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালত প্রাঙ্গণে মাঝেমধ্যেই পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়। মাদকদ্রব্য পোড়ানোর জায়গাটি রাস্তার কাছাকাছি খোলা আকাশের নিচে।

মাদকদ্রব্য পোড়ানোর সময় এ এলাকায় অবস্থান করা বিচারক, পুলিশ, আইনজীবী, পথচারী, বিচারপ্রার্থীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই ধোঁয়া ও উৎকট গন্ধে অতিষ্ঠ হয়ে যান। আদালত চত্বরের আশপাশের বাসা-বাড়ির বাসিন্দাসহ সবাই দুর্ভোগে পড়েন। শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত লোকজন বিপদে পড়েন সবচেয়ে বেশি।

আদালতপাড়ায় গণপূর্ত বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপপরিচালক মাসুদুল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিচারপ্রার্থীরা যেন সুপেয় পানি পায় সেজন্য আমরা প্রতিটা ফ্লোরে একটি করে ফিল্টার লাগানোর পরিকল্পনা করছি।

“পাশাপাশি আদালতে টয়লেটগুলো নতুন করে মেরামত করা হবে, ইতোমধ্যে চাহিদা দেওয়া হয়েছে। জেলা জজ ও মহানগর আদালতের ভবনে আধুনিক টয়লেট করা হবে।”

বিচারপ্রার্থীদের বসার ও বিশ্রামের ব্যবস্থা বিষয়ে তিনি বলেন, “আমরা বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি কমানোর জন্য চেষ্টা করছি। আশা করি, দুই থেকে তিন মাসের মধ্যে আদালতের অনেক সমস্যা সমাধান হবে।

“ইতোমধ্যে মহানগর ও জেলা জজ আদালতে কিছু বেঞ্চ দিয়েছি বিচারপ্রার্থীদের বসার জন্য। সিএমএম আদালতেও দেব। তাছাড়া শুধু ন্যায়কুঞ্জ দিয়ে হবে না, আমরা বাগানের রেলিং টাইলস করে দেব, যেন বিচারপ্রার্থীরা বসতে পারেন।”

ঢাকা আইনজীবী সমিতির অ্যাডহক কমিটির সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আদালতে বিচারপ্রার্থীদের বিশ্রাম নেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে ন্যায়কুঞ্জ উদ্বোধন করা হয়েছে। শিগগিরই চালু হচ্ছে। আমাদের আদালতে জায়গা সংকট। তাও কীভাবে এ সমস্যা সমাধান করা যায়, আমরা চেষ্টা করছি।”

ঢাকার আদালত পাড়ায় ১১৮টি আদালতের মধ্যে ঢাকা জেলা ও দায়রা এবং বিচারিক হাকিম আদালত ৪০টি। ঢাকার মহানগর ও দায়রা জজ আদালত ১৬টি। মহানগর মুখ্য হাকিম আদালত ৩৪টি। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ৯টি। সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনাল ১টি। সাইবার আদালত ১টি। জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল ১টি। বিশেষ জজ আদালত ১০টি। পরিবেশ আদালত ২টি। এছাড়াও দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল রয়েছে ৪টি।

ন্যায়কুঞ্জে যা আছে

২০২৩ সালের ১৩ জুলাই ঢাকা জেলা জজ আদালত প্রাঙ্গণে বিচারপ্রার্থীদের জন্য ন্যায়কুঞ্জ এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন সাবেক প্রধান বিচরিপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। পরবর্তী সময় ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ মো হেলাল উদ্দিন চলতি বছরের ২৬ নভেম্বর এর উদ্বোধন করেন।

উদ্বোধন করা হলেও ন্যায়কুঞ্জ এখনো চালু হয়নি। এখানে ৭২ জনের বসার জায়গা, ব্রেস্টফিডিং রুম, আর একটি ফাস্টফুডের দোকান ও সুপেয় পানির ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্ত এখানে কোন শৌচাগার নেই।

এ বিষয়ে আদালতে গণপূর্ত বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উপপরিচালক মাসুদুল হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এখানে শৌচাগার হওয়ার কথা ছিল। নকশাতেও ছিল। আশেপাশে অফিস রয়েছে ক্যাফে থাকবে, তাই জেলা জজের পরামর্শে তা বতিল করা হয়। ন্যায়কুঞ্জের জন্য আলাদা শৌচাগার করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।