সেলিম শহিদ হয়েছেন, গর্ব পরিবারের

প্রকাশিত: ১১:৩৯ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ৮, ২০২৫

‘আমার পুত্র আলামিন ইসলাম ওরফে সেলিম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দিয়ে দেশের জন্য শহিদ হয়েছেন। আমি আমার শহিদ পুত্রের জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।’ দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার ১১ নম্বর মরিচা ইউনিয়নের ডাবরা জিনেশ্বরী গ্রামের বাসিন্দা ৬২ বছর বয়সী ওয়াজেদ আলী কান্নাজড়িত কণ্ঠে এ কথাগুলো বলছিলেন। শহিদ আলামিন ইসলাম সেলিমের পিতা ওয়াজেদ আলীর দুই ছেলে, এক মেয়ে। তিন সন্তানের মধ্যে বড় আলামিন ইসলাম ওরফে সেলিম (২৭), দ্বিতীয় পুত্র শাকিল ইসলাম (২৪) ও ছোট কন্যা আমেনা খাতুন (১১)।

ওয়াজেদ আলী ১৯৯৯ সাল থেকে ঢাকার সাভার উপজেলার সভাপুর এলাকায় আফা ফিল্টার কারখানায় সিকিউরিটি গার্ড হিসেবে চাকরি করেন। একই সময়ে ওয়াজেদ আলী তার স্ত্রী সালমা বেগম ও দেড় বছর বয়সের পুত্রসন্তান সেলিমকে নিয়ে এ এলাকায় বসবাস করে আসছিলেন। এরপর এখানেই তার দ্বিতীয় ছেলে শাকিল ইসলাম ও ছোট কন্যা আমেনা খাতুনের জন্ম হয়।

সেলিম নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে বাবার সংসারের হাল ধরতে ঢাকার আমিনবাজার ব্যান্ডো ইকোফার গার্মেন্টসে অপারেটর হিসেবে চাকরি শুরু করেন। সেলিম চার বছর আগে দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার শন্কা গ্রামের সামিউল ইসলামের কন্যা সুমাইয়া বেগমকে বিয়ে করেন। এ দম্পতির ২ বছর ৩ মাস বয়সের একটি শিশুসন্তান রয়েছে। তার নাম আব্দুল্লাহ হুজাইফা। পুত্র সেলিম, পুত্রবধূসহ সবাই একই সঙ্গে সভাপুর এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় বসবাস করতেন।

সেলিমের ভাই শাকিল ইসলাম এসএসসি পাস করেছে। শাকিল একটি ইলেকট্রনিক কারখানায় কাজ করে। বোন আমেনা খাতুন একটি প্রাইমারি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। ছেলে, মেয়ে ও পরিবার-পরিজন নিয়ে ওয়াজেদ আলীর সংসার ভালোই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করে এতে ছন্দপতন ঘটে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সেলিমের যোগ দেওয়া এবং অকালে তাকে পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার ঘটনায় সব ওলট-পালট হয়ে যায় পরিবারটির। দেশের জন্য সেলিমের জীবনদান নিয়ে পরিবারটি নিজেদের গর্বিত মনে করে। তবে ওয়াজেদ আলী ও তার স্ত্রী সালমা বেগম পুত্রশোকে দিনরাত কান্নাকাটি করে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর ঢাকার সাভার এলাকার মহাসড়কে আনন্দ মিছিল হচ্ছিল। সেলিমের কারখানা বন্ধ থাকায় তিনিও এ মিছিলে যোগ দেন। হঠাৎ ওই মিছিলে আওয়ামী নেতা-কর্মীরা অতর্কিত হামলা চালান। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও আন্দোলনে যোগ দেওয়া ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে। এতে অসংখ্য ছাত্র-জনতা গুলিবিদ্ধ হন।

ওই দিন সন্ধ্যার পর ওয়াজেদ আলীর কাছে একজন ফোনে সেলিমের মৃত্যুর খবর জানান। এই সংবাদ পেয়ে ছোট ছেলে শাকিল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে মুক্তির মোড়ে যান তিনি। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে নিহত ও আহতদের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তারা পরে এনাম মেডিকেলে যান। এনাম মেডিকেলে গিয়ে দেখেন, অসংখ্য লাশ স্তূপ করে রাখা হয়েছে। হাসপাতালের সর্বত্র রক্ত আর রক্ত। কোথাও পা দেওয়ার জায়গা নেই।

তারা পিতা-পুত্র মিলে এক ঘণ্টা খোঁজাখুঁজি করে পরে সেলিমের লাশ শনাক্ত করেন। অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে সেখান থেকে শহিদ সেলিমের লাশ বাড়ি নিয়ে আসেন। পরদিন ৬ আগস্ট ভোরে তারা দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার গ্রামের বাড়ি এসে পৌঁছান। দুপুর সাড়ে ১২টায় পারিবারিক কবরস্থানে সেলিমের লাশ দাফন করা হয়।

শহিদ সেলিমের নানা বীর মুক্তিযোদ্ধা তছির উদ্দিন (৮০) কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘এখনো এই বয়সে বেঁচে রয়েছি। বিধাতার কী নির্মম পরিহাস। এই অল্প বয়সে আমার নাতির অকালমৃত্যু দেখতে হলো।’ মা সালমা বেগম তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকেন। এর মধ্যে সেলিমের স্ত্রী সুমাইয়া জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তাকে পরিবারের লোকজন জ্ঞান ফেরানোর জন্য মাথায় ও শরীরে পানি দিয়ে বাতাস করতে থাকেন।

সুমাইয়ার জ্ঞান ফেরার পর তিনি বলেন, ‘আমার আর বেঁচে থেকে লাভ কী? ২ বছর ৩ মাস বয়সের একটি শিশুপুত্রকে নিয়ে বিধবা হলাম। আমার কি অপরাধ ছিল যে, আমাকে এভাবে এই বয়সে স্বামীহারা হতে হলো।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার স্বামীকে যারা গুলি করে হত্যা করেছে, আমি তাদের বিচার চাই। আমি হত্যাকারীদের কোনো দিন ক্ষমা করব না। আমার এই শিশুসন্তান এই বয়সে এতিম হয়ে গেল। আমার শিশুসন্তান আর কোনো দিন তার বাবার স্নেহ-ভালোবাসা পাবে না। এই এতিম সন্তানটির কী হবে, কে তাকে দেখবে। আমি একজন মেয়েমানুষ, আমার পক্ষেইবা কী করার আছে?’ এসব কথা বলে সবার কাছে তিনি জবাব জানতে চান। কিন্তু এসব প্রশ্নের কি জবাব দেওয়া যায়! আত্মীয়স্বজনরা তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।

এদিকে ওয়াজেদ আলী বাধ্য হয়ে বর্তমানে পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামে বাস করছেন। তিনি বলেন, ‘আমার থাকার মতো গ্রামে শুধু ৪ শতক জমির ওপর দুটি ঘর রয়েছে। আমার নিজের আর কোনো জমিজমা নেই। পুত্র সেলিম শহিদ হওয়ার পর থেকে আমি ও আমার স্ত্রী শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছি। ভারী কাজকর্ম করতে পারি না। ছোট পুত্র শাকিল ইলেকট্রনিক মিস্ত্রির কাজ করে কোনো রকমে সংসার চালাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘সেলিমের স্ত্রী সুমাইয়া বেগম এই অবস্থায় তার শিশুসন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়িতে রয়েছেন। আমার পরিবারটা এলোমেলো অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ছোট মেয়ে আমেনা খাতুন সাভারের একটি স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ত। এই ডিসেম্বর মাসে তার বার্ষিক পরীক্ষা হতো। গ্রামে থাকার কারণে তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। বিষয়টি নিয়ে আমার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আতাহারুল ইসলাম চৌধুরীকে বলার পর তিনি গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।’

বীরগঞ্জ উপজেলা জামায়াতের আমির মাওলানা মো. খোদাবক্স দলের পক্ষ থেকে তাদের এক লাখ টাকা দিয়েছেন বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি ওই টাকা থেকে আমার শহিদ পুত্র সেলিমের স্ত্রী সুমাইয়া বেগমকে ৫০ হাজার টাকা দিয়েছি। গত ২৫ দিন আগে শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন থেকে ৫০ হাজার টাকা এবং গত ২৮ নভেম্বর দিনাজপুর জেলা প্রশাসকের পক্ষ হতে ২৫ হাজার টাকা সাহায্য প্রদান করেছে। আমার ছেলের বউকে এলাকার সবাই পরামর্শ দিয়ে কলেজে ভর্তি করে দিয়েছে। তাকে লেখাপড়া শেষ করে একটি কাজে দেওয়ার জন্য এলাকার নেতারা সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন।’

মা সালমা বেগম বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। প্রায় ৩০ বছর যাবৎ আমরা ঢাকার সাভারে কারখানায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছি। আমার ছেলে সেলিম আন্দোলনে অংশ নিয়ে অকালে জীবন দিয়েছে। তাকে হারানোর শোক আমরা এখনো সামলে উঠতে পারিনি।’ তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে পুত্র হত্যার বিচার দাবি করেন।

শহিদ সেলিমের ছোট ভাই শাকিল ইসলাম বলে, ‘আমরা সাভার এলাকায় পরিশ্রম করেই আমাদের জীবন চালাচ্ছিলাম। কিন্তু সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। আমার ভাই দেশের জন্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে শহিদ হয়েছেন। এটা আমি গর্ব করে বলতে পারি।’

বীরগঞ্জ উপজেলার ১১ নম্বর মরিচা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আতাহারুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমার এলাকার দরিদ্র ওয়াজেদ আলী তার পরিবার নিয়ে ঢাকা সাভারে কারখানায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তার পুত্র সেলিম শহিদ হয়েছেন। কিন্তু ঢাকার সাভারে সন্ত্রাসীদের কারণে তারা বসবাস করতে পারছেন না।’ তিনি আরও বলেন, ‘যারা ওয়াজেদ আলী ও পরিবারের ক্ষতি করতে চায়, ওই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে উপযুক্ত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাই।’ সূত্র: বাসস