একলা পথে এক শান্তির খোঁজে প্রকাশিত: ৭:২১ অপরাহ্ণ, মে ২২, ২০২৫ সফিউল ইসলাম জীবনের ক্লান্তিকর ছকে বন্দি হয়ে যখন মন চিৎকার করে ওঠে একটু মুক্ত হাওয়ার জন্য; তখন একটুখানি সমুদ্রের ঢেউ, একটু নীলাকাশ আর এক চিমটি নীরবতা অনেকটা শান্তি এনে দিতে পারে। ঠিক এমন এক সন্ধ্যায়, অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীরে বিছানায় হেলান দিয়ে ছিলাম। হঠাৎ ফেসবুকে চোখে পড়ল আকিলপুর সমুদ্রসৈকতের একটি ছবি। ছবির পেছনে সূর্য ডুবে যাচ্ছে, নরম সোনালি আলো পানির গায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। তখনই মনে হলো– জায়গাটায় আমাকে যেতেই হবে! সীতাকুণ্ড নামটা চট্টগ্রামের মানুষদের কাছে নতুন কিছু নয় কিন্তু আকিলপুর? আমার জানা ছিল না। তথ্য খুঁজতে গিয়ে দেখি, এখনো পর্যটকদের ভিড়ে বিরক্ত হয়নি জায়গাটা। নিরিবিলি, শান্ত, যেন এক অলিখিত প্রতিজ্ঞায় নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে। পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি সিদ্ধান্তটা নেওয়ার পর শুরু হলো ছোট্ট প্রস্তুতি। এটি ঠিক কোনো ট্রেকিং নয়, তাই ভারী ব্যাগপত্র নেওয়ার দরকার পড়েনি। কিন্তু সমুদ্রের ধারে সময় কাটানো, কিছু ছবি তোলা আর সন্ধ্যায় বালি ভেজানো হেঁটে বেড়ানোর মতো কিছু সময় নিজের জন্য রাখার পরিকল্পনা ছিল। সঙ্গে নিলাম—হালকা কটন জামা, ক্যামেরা, সানস্ক্রিন, স্ন্যাক্স, ফাস্ট এইড। গন্তব্য আকিলপুর, সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম। যাত্রা: চট্টগ্রাম থেকে সীতাকুণ্ড হয়ে আকিলপুর সকালে আমি চট্টগ্রাম শহর থেকে রওয়ানা দিলাম। যেহেতু সীতাকুণ্ড চট্টগ্রাম শহর থেকে খুব বেশি দূরে নয় (প্রায় ৪০ কিলোমিটার)। তাই বাস কিংবা সিএনজি করেই যাওয়া যায়। আমি স্থানীয় বাস নিলাম–‘সীতাকুণ্ড এক্সপ্রেস’। সকাল ৮টা নাগাদ বাস ছাড়ল। জানালার পাশে বসে আমি বাইরের দৃশ্য দেখছিলাম, একটু একটু করে শহরের কোলাহল পেছনে পড়ে যাচ্ছে আর প্রকৃতি আপন রূপে ধরা দিচ্ছে। সীতাকুণ্ড বাজারে পৌঁছাতে সময় লাগল প্রায় ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট। সেখান থেকে সিএনজি বা অটো করে যাওয়া যায় আকিলপুর পর্যন্ত। স্থানীয় লোকজন বেশ সহৃদয়। আমি একজন দোকানদারের সাহায্যে অটো খুঁজে পেলাম। আমার গন্তব্য জানাতেই তিনি বললেন, ‘আকিলপুর? ভাই, অসাধারণ জায়গা! এখনো মানুষের ভিড়ে নষ্ট হয়নি। আপনি নিশ্চিন্তে ঘুরে আসেন।’ কথাগুলো আমার ভেতরের আগ্রহটা আরও বাড়িয়ে দিলো। আকিলপুরে প্রথম পা রাখার মুহূর্ত যখন পৌঁছালাম, তখন প্রায় দুপুর ১২টা। কিন্তু রোদটা ছিল বেশ সহনীয়। সামনে বিস্তীর্ণ বালুর চর, আর দূরে একটানা ঢেউ এসে বালি ছুঁয়ে আবার ফিরে যাচ্ছে। কানে আসছিল সমুদ্রের মৃদু গর্জন, আকাশটা যেন এক বিশাল নীল ক্যানভাস–তার মাঝে ছোট ছোট কিছু সাদা মেঘ এঁকে দিয়েছে প্রকৃতি নিজ হাতে। আমি এক মুহূর্তের জন্য থেমে দাঁড়িয়ে রইলাম। জীবনের সমস্ত যান্ত্রিকতা ভুলে শুধু সেই ঢেউয়ের শব্দ শুনছিলাম। সেই সময়টুকু যেন একান্তই আমার ছিল। খাবারের গল্প অবশ্য এতটা ভ্রমণের পর ক্ষুধা চেপে বসেছিল বেশ। আকিলপুরে তেমন কোনো বড় হোটেল নেই। তবে ছোট ছোট কয়েকটি চা দোকান, ভাজি-পারোটা পাওয়া যায়। আমি একটা ছোট্ট দোকানে ঢুকলাম–নাম ছিল ‘সৈকত টি স্টল’। চায়ের সঙ্গে গরম সিঙারা, বেগুনি আর এক প্লেট ভেজিটেবল খিচুড়ি। বিশ্বাস করুন, শহরের দামি হোটেলের খাবারের চেয়ে কম নয় স্বাদে–হয়তো পরিবেশ আর ক্ষুধার কারণে এমন লেগেছে। তবে আসলেই খুব ভালো লেগেছিল। দোকানের এক আন্টি রান্না করছিলেন। আমি বললাম, ‘আপনার রান্না খুব মজার!’ তিনি হাসলেন, ‘ভাই, এখানে আসা মানুষদের মনটা ভালো থাকে, তাই খাওয়াও ভালো লাগে।’ মানুষ ও পরিবেশ আকিলপুরের মানুষ খুব সরল, অতিথিপরায়ণ। আমি বেশ কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি–একজন জেলে বলছিলেন, ‘ভোরবেলা সমুদ্র একেবারে অন্যরকম হয়, পাখিরা গান গায় আর সূর্য উঠতে উঠতে পানির ওপর সোনার রং লাগে।’ একটি পরিবার এসেছিল সীতাকুণ্ড থেকে পিকনিকে। তারা পাতা বিছিয়ে খাবার খাচ্ছিল আর বাচ্চারা বালি নিয়ে খেলা করছিল। এসব দৃশ্য মনটা আরও প্রশান্ত করছিল। ছবির খেলা ও স্মৃতি তৈরি আমি আমার মোবাইল নিয়ে বের হলাম সৈকতের ধারে ছবি তুলবো বলে। জলের ছিটায় ভেজা পাথর, বালুর ওপর ছায়া, আকাশের প্রতিচ্ছবি–সবকিছুই এত ছবির মতো লাগছিল যে, কোনটা ফ্রেমে রাখি আর কোনটা ছেড়ে দিই, বুঝতে পারছিলাম না। একটা সময় পায়ের জুতা খুলে পানির ধারে হেঁটে গেলাম। ঢেউ এসে পায়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে, আবার ফিরে যাচ্ছে। একধরনের খুনসুটি যেন–প্রকৃতি তার মতো করে খেলছে আমার সঙ্গে। সূর্য যখন নামতে শুরু করে বিকেলের দিকে আকিলপুর তার আরেক রূপ দেখাতে শুরু করল। সূর্য যেন আস্তে আস্তে জলরঙে আঁকা ছবির মতো লালচে, সোনালি আভা ছড়িয়ে দিতে লাগল। চারপাশে যেন এক মায়াবী আলোর পর্দা। পেছনের পাহাড় চূড়াগুলো রং বদলাতে লাগল–একবার হালকা বেগুনি, কখনো লালচে ধূসর। আমি বালিতে বসে ছিলাম একদম সৈকতের ধারে। পাশে বসে থাকা আরেকজন ভ্রমণপিপাসু তরুণ বলল, ‘ভাই, এই জায়গাটায় সূর্যাস্ত দেখার সময় মনটা অন্য জগতে চলে যায় না?’ আমি শুধু মাথা নেড়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, মনে হয় যেন কিছুই ভাবতে হচ্ছে না, কিছুই বলতে হচ্ছে না–শুধু থাকলেই সব কিছু হয়ে যায়।’ ঢেউগুলো যেন তখন একটু বেশি আলগা হয়ে বয়ে যাচ্ছিল। সূর্য একসময় ঢেউয়ের পেছনে লুকিয়ে গেল কিন্তু তার আলো থেকে গেল বালির মাঝে। সেই আলো যেন আমাকে কানে কানে বলল, ‘তুমি ঠিক জায়গাতেই এসেছো।’ SHARES লাইফস্টাইল বিষয়: নিরিবিলিশান্ত