পরিবেশবান্ধব যান সাইকেলের লেন ঝুলছে শুধু ‘সাইনবোর্ডে’ প্রকাশিত: ১২:১৬ অপরাহ্ণ, জুন ৪, ২০২৫ প্রথমবারের মতো দেশে বাইসাইকেল লেন পেয়ে খুশিতে আত্মহারা ছিলেন সাইক্লিস্টরা। বছর না ঘুরতেই সে খুশি ফিকে হতে শুরু করে। সুপ্রশস্ত সড়কের কালো পিচের ওপর সাদা, হলুদ, নীল রঙের প্রলেপে ঝকঝকে-তকতকে বাইসাইকেল চিহ্ন আঁকা লেন হতে থাকে ধূসর। হয়ে যায় দখল। এখন সেখানে গাড়ির পার্কিং, খাবারের দোকান কিংবা ময়লার ভাগাড়! উন্নত শহরের আদলে বাইসাইকেল চালকদের জন্য ২০১৯ সালে রাজধানীর আগারগাঁও ও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে আলাদা লেন তৈরি করেছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। কদিন না যেতেই শুরু হয় দখল। পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও দখলমুক্ত হয়নি বাইসাইকেলপ্রেমীদের সেই লেন।সরেজমিনে রাজধানীর আগারগাঁও ও মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ এলাকার বাইসাইকেল লেন ঘুরে দেখা যায়, আগারগাঁও-৬০ ফিট রোডের মাথা থেকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স অ্যান্ড হাসপাতালের সামনে দিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর, নির্বাচন কমিশন ভবনের সামনে দিয়ে এলজিইডি সড়ক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন পর্যন্ত চালু করা বাইসাইকেল লেন বলতে যেন কিছুই অবশিষ্ট নেই। একসময় সব সড়কেই সাইনবোর্ড থাকলেও নির্বাচন ভবনের সামনেরটি ছাড়া অন্যগুলোর অস্তিত্ব নেই। এসব সড়কে যে সাইকেল লেন ছিল তার একমাত্র প্রমাণ বোধহয় এখন সাইনবোর্ডটি। সাইকেল লেনে যানবাহন-দোকান সড়ক ঘুরে দেখা যায়, সরকারি যানবাহন, ব্যক্তিগত গাড়ি, স্টাফ বাস, লেগুনা, অ্যাম্বুলেন্স, চায়ের দোকান, রিকশার গ্যারেজ, এমনকি অবৈধভাবে লেনের ওপরই গড়ে তোলা হয়েছে ভ্রাম্যমাণ দোকান। সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের সামনের সড়কের বাইসাইকেল লেনের স্থান ঢেকে রেখেছে সারি সারি যানবাহন। খালি চোখে বোঝার উপায় নেই যে পাঁচ বছর আগে এখানে চালু করা হয়েছিল বাইসাইকেল লেন। সাইক্লিস্টরা বলছেন, ঢাকায় অন্তত যে দুটি লেন তাদের ছিল তা অনেক আগেই দখল হয়ে গেছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কোনো নজরই নেই। সাইকেলকেন্দ্রিক বিভিন্ন দিবসে সাইকেল লেনের দাবি করা হলেও কেউ মনে রাখে না আমাদের। ঢাকার সড়কে সাইকেল চালানো যে কত কষ্টের তা কেউ বুঝবে না। যে দুটি লেন ছিল অন্তত সে দুটি দখলমুক্ত করা হোক। ঢাকার অন্য সড়কেও লেন বাস্তবায়ন করা হোক।ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা যায়, রাজধানী ঢাকায় বাইসাইকেল চলাচল উৎসাহিত করতে আগারগাঁওয়ে প্রায় নয় কিলোমিটার সড়কে আলাদা লেন তৈরি করা হয়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নে আলাদা সাইকেল লেন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই। ২০২০ সালের মার্চে আগারগাঁওয়ে অবস্থিত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উত্তর প্রান্ত থেকে এলজিইডি সড়ক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ভবন পর্যন্ত চালু করা হয় আলাদা লেন। ওই সময় ডিএনসিসি কর্মকর্তারা জানান, সাইকেলের জন্য ছয় ফুট প্রশস্ত আলাদা লেন চালুর মধ্য দিয়ে বদলে যাবে আগারগাঁও এলাকার চিত্র। মডেল সড়ক হিসেবে সাইকেল লেন তৈরির পাশাপাশি ফুটপাত, অনস্ট্রিট পার্কিং ও সবুজায়নে আগারগাঁও হবে মডেল এলাকা। অথচ মডেল এলাকা কেবল কাগজে-কলমেই থেকে যায়। দখলে চলে যায় সাইকেল লেন। ফলে আগের মতো ঝুঁকি নিয়ে মূল সড়কে চলাচল করতে হয় সাইকেলচালকদের। সাইকেল লেন আছে জানেনই না গাড়িচালকরা পরমাণু শক্তি কমিশনের সামনের সড়কের সাইকেল লেন দখল করে পার্কিং করা একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের স্টাফবাসের চালকের কাছে বাইসাইকেল লেন সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘এখানে লেন কই? কখনো তো শুনিনি, আলাদা লেন আছে নাকি? এখানে তো বড় গাড়িই রাখতে দেখি।’নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের সামনের সড়কের বাইসাইকেল লেনে লেগুনা, হাসপাতালের চিকিৎসক ও রোগীর স্বজনদের ব্যক্তিগত গাড়ির সারি। অ্যাম্বুলেন্স তো আছেই। ব্যক্তিগত গাড়ি পার্কিং করার সময় জানতে চাওয়া হলে চালক মিন্টু হোসেন বলেন, ‘এখানে প্রতিদিনই আসি। কখনো ট্রাফিক পুলিশ কিছু বলেনি।’ পরিবেশ অধিদপ্তর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, নির্বাচন কমিশন ভবন, এনজিও ব্যুরো, পিকেএসএফ কার্যালয়সহ আগারগাঁওজুড়ে যেন যানবাহন আর দোকানের রাজত্ব। তবে, একটু হলেও বাইসাইকেল লেন খুঁজে পাওয়া গেছে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে। সেখানে চালু হওয়া এক কিলোমিটার লেনের ওপরে দেখা গেছে সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তিগত বিভিন্ন গাড়ি। ভ্যান-রিকশাও পার্কিং অবস্থায় দেখা যায়। ৫ আগস্টের পর সাইকেল লেনের ওপর বসানো হয়েছে দোকান। রাজধানীর শ্যামলী এলাকায় থাকেন মশিউর রহমান নামে একজন বেসরকারি চাকরিজীবী। তার অফিস গুলশান-১ নম্বর এলাকায়। তিনি প্রতিদিন প্রায় ২২ থেকে ২৫ কিলোমিটার সাইকেলে যাতায়াত করেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগারগাঁও সড়কে সাইকেল লেন ছিল কিন্তু এখন আর নেই। সাইকেল লেন ছাড়া যাতায়াত করা খুবই কষ্টসাধ্য। কয়েক মাস হলো শুরু হয়েছে অটোরিকশার যন্ত্রণা। আর বড় বাস কিংবা বেপরোয়া গতির মোটরসাইকেলসহ অন্য গাড়ি তো আছেই।’বিডিসাইক্লিস্টসের মডারেটর ফুয়াদ আহসান চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রতিদিন দুই থেকে তিন লাখ মানুষ ঢাকা শহরে বাইসাইকেল চালায়। এদের বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত-নিম্ন মধ্যবিত্ত। আগারগাঁওয়ে যে সাইকেল লেন করা হয়েছিল সেটি এখন অন্যদের দখলে। বড় জায়গাজুড়ে সেখানে সাইকেল নিয়ে মানুষ খুব কম যাতায়াত করে। ঢাকায় অন্য আরও জায়গা আছে সেখানে সাইকেল লেন করা যেত। মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতেও একই অবস্থা। কারণ মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ বড় সড়ক সেখানে আলাদা করে সাইকেল লেন করার প্রয়োজন ছিল না।’ তিনি বলেন, ‘ভিজ্যুয়ালি সাইকেল লেন নামের জন্য এটা করা হয়েছিল সে সময়। প্রগতি সরণি, বিমানবন্দর সড়ক, মহাখালী, মিরপুরসহ এমন অনেক সড়কে সাইকেল লেন করা যেত, যেখানে সাইক্লিস্টরা নিয়মিত চলাচল করেন।’ শুধু লেন নয়, পার্কিংয়েও গুরুত্ব সাইকেল লেনের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপদ পার্কিং উল্লেখ করে ফুয়াদ আহসান বলেন, ‘তিন থেকে সাড়ে তিন ফুট জায়গা হলেই একজন সাইকেল নিয়ে চলাচল করতে পারেন। সাইকেল চলাচল করলে অন্য যানবাহনে চাপ কম পড়ে। এজন্য সাইক্লিস্টদের প্রয়োজন নিরাপত্তা। ২০১৪ থেকে ঢাকা শহরের অনেক অফিস কিংবা মার্কেটের পার্কিং সাইকেল পার্কিং অনুমোদন করে না। পার্কিং ব্যবস্থা থাকলে সাইকেল চলাচল বাড়তো।’ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাইক্লিং ক্লাবের সভাপতি মো. তাওহীদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঢাকা শহরে সাইকেল চলাচলে নিরাপত্তা এখনো তৈরি হয়নি। তবুও অনেক মানুষই এখন এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সাইকেল চালিয়ে যাতায়াত করছেন। আমাদের প্রধান দাবি ছিল সাইকেল লেন। ঢাকায় সাইকেল লেন হলেও সেটি আর সাইকেলচালকদের জন্য নেই। দখল হয়ে গেছে অনেক বছর আগেই। আরেকটি দাবি সাইকেল পার্কিং ব্যবস্থা। কারণ আমি বাসা থেকে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যদি পার্কিং না পাই তাহলে নিশ্চয় সাইকেল নিয়ে বেরোতে পারবো না। এখন অনেক দামি সাইকেল কিনছেন অনেকে। শুধু পার্কিংয়ের ব্যবস্থা না থাকায় ইচ্ছা থাকলেও সাইকেল বের করতে পারছেন না কেউ কেউ।’ বাংলাদেশ সাইকেল লেন বাস্তবায়ন পরিষদের সভাপতি মো. আমিনুল ইসলাম টুববুস জাগো নিউজকে বলেন, ‘হাঁটার বিকল্প হিসেবে মানুষের প্রথম বাহন বাইসাইকেল। এই জনবহুল শহরে স্বস্তিতে পথ চলতে বাইসাইকেলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠছে বিভিন্ন বয়সের মানুষে। সঠিক সময়ে গন্তব্য পৌঁছানো ও বাধাহীন পথ চলতে সাইকেলের কোনো বিকল্প নেই। সুস্বাস্থ্য, বায়ুদূষণ রোধ, জ্বালানি সাশ্রয়, শব্দদূষণ রোধ, পরিবেশ সুরক্ষায় সাইকেল লেনের দাবিতে প্রতি বছর এপ্রিল মাসের প্রথম শুক্রবার সাইকেল লেন দিবস পালন করে আসছি।’ বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ জাগো নিউজকে বলেন, ‘পৃথিবীর সব দেশ এমনকি যে দেশ গাড়ি আবিষ্কার করছে তারাও বুঝতে পেরেছে গাড়িনির্ভরতা পরিবেশ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার জন্য ক্ষতি। তারা এখন সবাই সাইকেলে চলে আসছে। শুধু আমরা উল্টো গাড়িনির্ভরতা বাড়িয়েই যাচ্ছি। সাইকেলবান্ধব শহর তৈরি না করতে পারলে ভবিষ্যতে আরও অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। সাইকেলবান্ধব শহর গড়তে গেলে সাইকেল পার্কিং এবং সাইকেল লেন করতে হবে।’ ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিশ্বের অনেক দেশেই বাইসাইকেল অন্যতম বাহন। কিন্তু বাংলাদেশে বাইসাইকেল লেন, পার্কিং ও সেফটি আগে কখনো করা হয়নি। কয়েক বছর ধরে বাইসাইকেলপ্রেমীরা প্রতিকূলতার মধ্যেও সাইকেল ব্যবহার করে লম্বা দূরত্ব পার করে অফিস-আদালতে যাচ্ছেন। সেই উদাহরণ তৈরি হয়েছে। সেই অনুযায়ী বাইসাইকেল লেন তৈরি হয়নি। বিচ্ছিন্নভাবে আগারগাঁও-মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে বাইসাইকেল লেন করা হয়েছিল। কিন্তু সেটি কাজে আসেনি। কারণ পুরো নেটওয়ার্কে যদি সাইকেল লেন না থাকে হঠাৎ করে মাঝের কোনো এক রাস্তায় লেন করলে কাজ হবে না।’ঢাকার বাইসাইকেল লেন সম্পর্কে জানতে চাইলে ট্রাফিক-তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. রফিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘মূল সড়কে দোকানপাট বসানোর কারণে যানজট ছড়িয়ে পড়ে। দোকান সরিয়ে দিলে কিছুক্ষণ পর এসে আবারও বসে যায়। এতে ট্রাফিক পুলিশের ভোগান্তির শেষ নেই। এত লোকও নেই আমাদের। স্থানীয় বাসিন্দাদের সচেতন হওয়া দরকার। সিটি করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কথা হয়েছে। তাদের পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা পেলে সাইকেল লেনগুলো উদ্ধার করা যাবে।’ সাইকেল লেনের বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা এ সম্পর্কে কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই বলে জানান। SHARES জাতীয় বিষয়: যানবাহনসাইকেল