লবণ মাখা ভাত আর মুড়ি দিয়েই কাটছে যাদের রোজরা

প্রকাশিত: ১০:৩৩ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ৩, ২০২৪

ইফতারের বাকি আর মাত্র আধাঘণ্টা। ঝুপড়ি ঘরের বাইরে বসানো মাটির চুলায় হলুদ ও লবণ মেশানো ভুট্টা সিদ্ধ করছিলেন মধ্যবয়সী এক নারী। কাছে গিয়ে কথা বলে জানা যায়, সিদ্ধ ভুট্টা দিয়েই ইফতার করবেন তিনি। শুধু এদিন নয়, এবারের রমজানের বেশিরভাগ সময়ই মুড়ি, লবণ মেশানো ভাত ও শাক দিয়ে ইফতার করেন তিনি। একই অবস্থা সেহেরিতেও।

এভাবেই নিজের কষ্টের কথাগুলো বলেন কক্সবাজার শহরের সমুদ্রের পাড়ের কবিতাচত্বর পাশে ঝাউবাগানের বস্তিতে বাস করা ফরিদ আলমের স্ত্রী মঞ্জুরা বেগম (৪৭)। শুধু তিনিই নন, ওই বস্তির অর্ধশত পরিবারের বেশিরভাগেরই জীবনের গল্পটা এমন। দারিদ্রতার মাঝে মানবেতর দিন কাটছে তাদের। একবেলা খেলে অন্য বেলায় কি খাবেন সেই চিন্তা নিত্যদিনের।

মঙ্গলবার (২ এপ্রিল) বিকেল পৌনে ৬টার দিকে ঝাউবাগানের বস্তিতে গিয়ে এই দৃশ্যের দেখা মেলে। কি দিয়ে সেহরি করেছিলেন- এর জবাবে মঞ্জুরা বেগম বলেন, ‘আজ শুকনা মাছ দিয়ে। গতকাল (সোমবার) লবণ মেশানো ভাত দিয়ে, আর তার আগের দিন শাক দিয়ে। তবে গত শুক্রবার পাঙাস মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে রোজা রেখেছি।’

এমন অবস্থার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘স্বামী পঙ্গু। কোনো ছেলে সন্তান নেই। পাঁচ সন্তানই মেয়ে। পরিবারে আমি ছাড়া আয় করার কেউ নেই। সমুদ্র পাড়ের সবজি ক্ষেতে কাজ করে, আর ভাঙ্গারি কুড়িয়ে যা পাই তা দিয়েই সংসার চলে। যেখানে দু’বেলা খাবার যোগাতে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে ভাল খাবার দিয়ে সেহরি-ইফতার করা বিলাসিতা।’

বস্তির আরেক নারী হালিমা খাতুন বলেন, ‘ক্ষেতের শাক বিক্রি করে দিনে ১০০ থেকে ২০০ টাকা পাওয়া যায়। ওই দিয়েই কোনোভাবে সংসার চলে। ইফতার মানেই শাক দিয়ে একদম রাতের খাবার। রোজার প্রথমদিনে ১ কেজি ছোলা-মুড়ি কিনেছিলেন। অল্প-অল্প দিয়েও চার সদস্যের পরিবারে অনেক আগেই তা শেষ হয়ে গেছে। খুব মন চায় একবেলা ভালো কিছু খেতে।’

মোতালেব মিয়া বলেন, ‘রিকশা চালিয়ে যে টাকা পাই তা দিয়ে ছয় সদস্যের সংসার ঠিকমতো চলে না। ছোট মেয়েটি অনেকবার মাংস দিয়ে ভাত, আর বড়লোকদের মতো ছোলা, মুড়ি ও সরবত দিয়ে ইফতার করতে চেয়েছে। সামর্থ না থাকায় তা এখনো পূরণ করতে পারিনি। নিজে না খেলেও সন্তানদের মাছ-মাংস খাওয়াতে মন চায়। যখন দেখি অন্যের বাচ্চারা ভালো-মন্দ খায় তখন খুব কষ্ট লাগে। কতো মানুষ সাহায্য-সহযোগিতা করে কিন্তু আমাদের কেউ করে না। অবশ্য লজ্জার কারণে কারও কাছে হাতও পাতিনি।’

কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সহকারী শিক্ষক (গণিত) মোহাম্মদ আশিক উল্লাহ বলেন, ‘অনেকের কাছে রমজান মানেই হরেক রকম খাবার দিয়ে ইফতার-সেহরি। অন্যদিকে অনেকে এক বেলা খাবার যোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন। রমজানের দিনেও ধনী-গরিবের বৈষম্য সত্যিই দুঃখজনক। বেশি না খেয়ে ভাগাভাগি করে খেলে এমন হতো না।’

সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থা (স্কাস) চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমা জানান, ঝাউবাগানের বস্তিবাসীর জীবন চিত্র দেখে খুবই খারাপ লাগছে। প্রতিবেশিকে উপোস রেখে পেট ভরে খেলে হবে না। অপ্রিয় হলেও সত্য অসুস্থ সমাজ ব্যবস্থায় এই চর্চাই চলছে। সচ্ছলদের প্রয়োজন অসহায় মানুষদের সহযোগিতার এগিয়ে আসা। এতে উপকৃত মানুষটি যেমন খুশি হবে, ঠিক তেমটি যে সহযোগিতা করছেন তারও ভাল লাগবে।’

কক্সবাজার পৌরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নুর মোহাম্মদ বলেন, ‘ঝাউবাগানের বস্তিবাসীরা খুবই দরিদ্র। খেয়ে না খেয়ে তাদের জীবন চলে। এই সমাজে অনেকে চাহিদার চেয়ে বেশি খাচ্ছেন। আবার অনেকে চাহিদাটাই পূরণ করতে পারছেন না। তারা না খেয়ে থাকার দায়ভার আমাদের সবার উপর পড়ে।‘

তিনি আরও বলেন, ‘কেউ ভাল খাবে আর কেউ একদমই খাবেন না, এমনটা হতে পারে না। তাদের সহযোগিতায় আমার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি বিত্তবানদেরও এগিয়ে আসতে হবে। তখনই এই হতদরিদ্র মানুষগুলো উপকৃত হবেন।’