স্রোতের বিরুদ্ধে তিন তরুণীর লড়াই, ‘রসদ’ মেটাল মিউজিক প্রকাশিত: ৫:১১ অপরাহ্ণ, জুন ৩০, ২০২৪ বিবিসিকে কুর্নিয়া বলেছেন, যখন তারা এই কনসার্টে পারফর্ম করার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন, তখন তারা মুহূর্তের জন্য কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে যান। জাভার হাইস্কুল পড়ুয়া তিন কিশোরী যখন কাঁচা হাতে মেটাল মিউজিক তৈরি করেছিল, তখন তারা ভাবতেও পারেনি, মাত্র এক দশকের মাথায় তারা ইংল্যান্ডের গ্লাস্টনবারি উৎসব মাতাবে। ‘ভয়েস অব বেসপ্রট’, বাংলায় যার অর্থ ‘কোলাহল’। নামের মতই শুক্রবার সংগীতের অন্যতম মঞ্চ গ্লাস্টনবারির কনসার্টে গিটার ও ড্রামের সঙ্গে দাপটে গান গেয়ে কোলাহল তুলেছেন বেইজ গিটারিস্ট বিদি রাহমাওয়াতি (২৩), ফিরদা মারসিয়া কুর্নিয়া (২৪) এবং ড্রামার ইউয়িস সিতি আইশা (২৪)। মাথায় হিজাব আর পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত লম্বা পোশাক পরে ইন্দোনেশিয়ার এই ত্রয়ী গিটার ও ড্রাম বাজিয়ে কেবল গানই করেন না, প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ভাঙার চেষ্টায় তারা নেমেছেন সংগীত নিয়ে। তারা প্রমাণ করতে চান, মুসলিম নারীরা হিজাব পরেও মেটাল বাজাতে পারেন। গিটারিস্ট ও ভোকালিস্ট ফিরদা মারসিয়া কুর্নিয়া বলেন, “নারীরা দুর্বল এবং ঢালাওভাবে মুসলমানরা জঙ্গি, এসব ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে আমরা গান করি।” গ্লাস্টনবারির উৎসবে তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয় মাসখানেক আগে। এখন পর্যন্ত যত মঞ্চে তারা পারফর্ম করেছেন, তার মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড়। বিবিসিকে কুর্নিয়া বলেছেন, যখন তারা এই কনসার্টে পারফর্ম করার আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন, তখন তারা মুহূর্তের জন্য কিছুটা বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। “এই উৎসবের গুরুত্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণা ছিল না। এতবড় একটি প্ল্যাটফর্মে যখন আমাদের ডাকা হল ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কি করতে হবে।” এই শিল্পীর ভাষ্য, ইউরোপের বৃহত্তম সংগীত উৎসবে পারফর্ম করার প্রথম সুযোগটি পাওয়া গেছে, এই বিষয়টি জানার পর থেকে তিনজনের ওপর এক ধরনের চাপ তৈরি হয়। বিদি বলেন, “ব্যান্ডের স্বকীয়তা প্রচার করার পাশাপাশি ইংল্যান্ডের কনসার্টে নিজ দেশের প্রতিনিধিত্বও করেছি আমরা।” পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মুসলিমপ্রধান দেশ ইন্দোনেশিয়া, যেখানে ৯০% মানুষ মুসলিম, সেই দেশে তিন নারী মিলে এই ব্যান্ড গড়ে তোলেন ২০১৪ সালে। তাদের পরিচয়ের শুরু ইসলামিক স্কুলে। ছোট বেলায় ইন্দোনেশিয়ান পপ এবং ইসলামিক সংগীত করতেন তারা। কিছুটা বড় হয়ে যখন মেটালে ঝুঁকেছিলেন, তখন ইসলামি আচারের মাধ্যমে ‘এক ধরনের চিকিৎসা’ করিয়ে তাদের মাথা থেকে মেটাল সংগীতের ভূত দূর করারও চেষ্টা চালানো হয় পরিবার থেকে। গান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ সফর করা এই ব্যান্ডের শিল্পীদের ভাষ্য, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য তারা গান করেন। আমেরিকান রক ব্যান্ড ‘রেইজ এগেইনস্ট দ্য মেশিন’র সদস্যরা বিবিসিকে বলেছে, ‘ভয়েস অব বেসপ্রট’ তাদের নজর কেড়েছে। এই দলের গিটারিস্ট টম মোরেলো বলেন, “ইন্দোনেশিয়ার নারীদের পারফর্মের ১০ মিনিটের একটি ভিডিও আমি দেখেছি, যা আমাকে বিস্মিত করেছে।” শেকল ভাঙার তাড়না কৈশোর থেকেই ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম জাভা প্রদেশের সিঙ্গাজায়ায় বেড়ে ওঠা মারসিয়া কুর্নিয়া ও ইইউএস সিতি আইশাহ পড়তেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। জুনিয়র হাই স্কুলে ওঠার পর তাদের পরিচয় হয় বিদির সঙ্গে। কৈশোর থেকেই তাদের মধ্যে নিয়ম ভাঙার কিছু প্রবণতা জন্মে। সেসব আচরণ এবং কর্মকাণ্ডের জন্য তিন বান্ধবীর প্রায়ই স্কুল কাউন্সিলরের অফিসে ডাক পড়ত। তবে সেই তলব তাদের জন্য আর্শীবাদ হয়ে আসে এক সময়। গাইডেন্স কাউন্সিলর ফাদার এরসা তখন তাদের মেটালের সঙ্গে প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। যদিও মেটালের প্রতি তাদের অনুরাগ তৈরি হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ‘সিস্টেম অব এ ডাউন’ নামের ব্যান্ডটির ‘টক্সিসিটি’ অ্যালবাম শোনার পরে। “আমরা ফাদার এরসার ল্যাপটপে গান শুনতাম। যখন হেভি মেটাল শোনায় ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি, তখন আমাদের মাথায় আসে, আমরা যদি এ ধরনের গান করতে পারি তাহলে দারুণ কিছু একটা হবে,” বলেন সিতি আইশাহ। বিদি বলেন, “আমাদের গ্রামে মেটাল মানেই শয়তানের কাজ। এটা মেয়েদের জন্য নয়, বিশেষ করে হিজাব পরা নারীদের।” ফাদার এরসা বলেন, “ আমি বুঝতে পেরেছিলাম এই তিন কিশোরী কোনো অর্থেই বিদ্রোহী নয়। মাদকের সঙ্গে বা অন্য কোনো ভুল পথে পা বাড়াবে-এমন ওরা কখনই ছিল না। ওরা প্রচলিত কিছু প্রথা বা স্কুলের কিছু নিয়ম কানুনের বিরোধিতা করত এবং সেসব নিয়ে প্রায়ই শিক্ষকদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়াত। ওদের কিছু কথাবার্তাকে অন্যদের জন্য উস্কানিমূলক হিসেবে ধরে নিয়েছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ।” ফাদার এরসা বিবিসিকে বলেছেন, তিনি চেষ্টা করেছেন সংগীতের প্রতি মেয়েদের আগ্রহী করে তুলতে। “কুর্নিয়ার হাতে গিটার ধরিয়ে দেই। বিদিকে বেইস গিটারের সঙ্গে পরিচয় করাই। আর একটি ড্রাম তৈরি করে দেই।” কুর্নিয়া বলেন, “আমরা অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে সমস্যা হত। আমাদেরকে মৌলবাদী বলে অভিযুক্ত করা হত। আমাদের গ্রামে, যে নারীরা প্রতিবাদ করবে তাদের পাগল বলা হত। আমাদের এসব ভালো লাগত না।” স্কুলের প্রতিও এক সময় তারা আগ্রহ হারাচ্ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, “নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল, আমাদের কেবল ভালো গ্রেড পেতে হবে। পড়া মুখস্ত করা, লেখা, বইপত্র গোছানো, ব্যস এটুকুই। ১২ বছর ধরে এই একঘেঁয়ে রুটিনে ছিলাম। আমরা বিরক্ত হয়ে পড়েছিলাম। ফাদার এরসা আমাদের সুরের দুনিয়ায় নিয়ে গিয়েছিলেন, যা আমাদের স্কুলের প্রতিও আগ্রহ ফিরিয়ে আনে।” আলোর পথ দেখানো ফাদার এরসাকে ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করেন তিন তরুণী। ‘ভয়েস অব বেসপ্রট’র গান প্রথম ইউটিউবে প্রকাশ করেছিলেনও তিনি। এখন ইউটিউবে এই দলটির সাবস্ক্রাইবার ৩ লাখ ৬০ হাজার এবং আর ইনস্টাগ্রামে তাদের অনুসরণ করেন ২ লাখ ৬০ হাজার মানুষ। SHARES বিনোদন বিষয়: কুর্নিয়াকোলাহলবিভ্রান্ত