ঈদে বাড়ি ফেরা মানুষের যাত্রা নিরাপদ হোক প্রকাশিত: ১:০৪ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২, ২০২৪ ঈদ মানেই নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা। দীর্ঘ সময় পরিবার থেকে আলাদা থাকার পর ঈদে কাছের মানুষদের কাছে যাওয়া হয়, আনন্দে কাটানো হয় কয়েকটা দিন। তাই ঈদে সবারই থাকে বাড়ি ফেরার তাড়া। ঈদে নগরবাসীর গ্রামমুখী হওয়ার সামাজিক, পারিবারিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বেশ কিছু কারণও রয়েছে। মুসলমানের সবচেয়ে বড় উৎসব ঈদ। স্বাভাবিকভাবেই এ উৎসব ঘিরে থাকে আবেগ। সে আবেগের টানেই মানুষের ঘরে ফেরা। কর্মসূত্রে বছরের বেশিরভাগ সময় মানুষকে দূর-দূরান্তে থাকতে হয়। ঈদের ছুটিতে তাই বাড়ি ফেরা নিয়ে তাদের অগ্রহ থাকে অনেক বেশি। এ সময় পরিবারের সবার সঙ্গে, আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ মেলে। কয়েকদিন পরেই মুসলমানদের বড় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদ। ঈদকে সামনে রেখে রাজধানী ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছেন নগরবাসী। শ্রেণি, ধর্ম-বর্ণ, ধনী, গরিব নির্বিশেষে সব মানুষ ভাগাভাগি করে নেয় ঈদের আনন্দ। ঈদের আনন্দ স্বজনদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য বিপুলসংখ্যক কর্মজীবী মানুষ ঢাকাসহ অন্যান্য বড় শহর থেকে পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যান। নিরাপদে বাড়ি ফেরার প্রত্যাশা থাকে সবার। এই আনন্দকে আরও পূর্ণতা দিতে এবং দুর্ভোগ কমানোর জন্য টিকিট কেনাবেচা ও যাত্রী পরিবহনের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করতে হবে। ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও লঞ্চ সড়ক ও নৌপথ থেকে সরানো জরুরি। নাড়ির টানে ব্যস্ততম নগর ছেড়ে রেল, নৌ ও সড়কপথে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন সবাই। ঈদের ছুটি শুরু হওয়ার আগেই ঘরমুখো মানুষের ভিড় দেখা যাচ্ছে বাস ও ট্রেনের টিকিট কাউন্টারগুলোতে। বাড়তি চাপ আর ঝুঁকি এড়াতে যারাই সুযোগ পেয়েছেন, ছুটছেন বাড়ির পথে। ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে সব ধরনের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন সরকারের পক্ষ থেকে। নানা ধরনের কর্মব্যস্ততা ও উন্নত জীবনধারার জন্য গ্রামের মানুষ শহরে বসবাস করলেও ঈদে সবারই থাকে বাড়ি ফেরার ব্যস্ততা, গ্রামে ফিরতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয় নগরবাসীদের। উৎসবকে কেন্দ্র করে বেড়ে যায় রোড অ্যাক্সিডেন্টের মাত্রা, বেড়ে যায় ছিনতাই, চুরি, চাঁদাবাজির মতো অনেক সামাজিক অপকর্ম। টিকিট ভোগান্তি, টিকিট পেলেও কয়েকগুণ বেশি দাম, যানজটসহ নানা ধরনের সমস্যায়ই পড়তে হয়। বিশেষ বা অতিরিক্ত বাস-ট্রেনও এই মানুষের স্রোত সামলে উঠতে হিমশিম খায়। উপরন্তু বেশি ভাড়ার বিড়ম্বনা। এ ছাড়া প্রতিবছর দেখা যায়, ঈদের সময় বিভিন্ন চক্র যেমন ছিনতাইকারী, মলম পার্টি, গামছা পার্টির আবির্ভাব হয়। বিশেষ করে মলম পার্টির প্রাদুর্ভাব ঈদের সময় বেশি দেখা যায়। তারা খাবারের মধ্যে নেশাজাতীয় বা চেতনানাশক দ্রব্য মিশিয়ে মানুষকে অজ্ঞান করে অর্থ, ফোন এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হাতিয়ে নেওয়াই তাদের কাজ। ঈদকে সামনে রেখে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে নিয়মমাফিক অতিরিক্ত পরিবহন সেবা চালু করা বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এত মানুষের একসঙ্গে ঘরে ফেরার জন্য প্রয়োজন নিরাপদ সড়ক ও পরিবহন ব্যবস্থা। বাংলাদেশের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম হলো সড়কপথ। অধিকাংশ মানুষ সড়কপথেই যাতায়াত করতে পছন্দ করেন। অথচ এই ঈদের সময় আমাদের দেশের সড়কগুলো যেন হয়ে উঠছে এক একটি মৃত্যুফাঁদ। প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়। কর্মব্যস্ত নগরী থেকে কিছুদিনের জন্য হলেও প্রিয়জনের সঙ্গে সময় কাটাতে চিরচেনা সেই নিজ বাড়িতে ছুটে যায় সব স্তরের মানুষ। মূলত নাড়ির টানে ঘরে ফেরা মানুষের আসল যুদ্ধ শুরু হয় পবিত্র ঈদ এলেই। এই সময় আনন্দযাত্রা ভোগান্তি দিয়েই শুরু হয় মানুষের। যত কষ্টই হোক না কেন, নিজের জন্মস্থান, গ্রামের বাড়িতে ঈদ উদযাপনে উদগ্রীব মানুষগুলো ছুটে আসছেন নিজ গন্তব্যে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রতিবছর ঈদ উৎসবের আগমুহূর্ত থেকেই ঘরমুখী মানুষের মনে নিরানন্দের সুর ধ্বনিত হতে দেখা যায়। টিকিট কালোবাজারি, যানজট, ছিনতাই-ডাকাতি ও চাঁদাবাজি, জালনোট, সড়ক ও লঞ্চপথে দুর্ঘটনা এবং শ্রমিক অসন্তোষের কারণে রাস্তা অবরোধসহ বিভিন্ন ঘটনায় জনদুর্ভোগ চরমে ওঠে। ঈদে মানুষের ঘরে ফেরা নির্বিঘ্ন করতে প্রতিবছর সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর পাশাপাশি নিরাপদ সড়কের জন্য নিয়মিত রাস্তাঘাট মেরামতসহ গতিবিধি মেনে গাড়ি চালানোর ব্যবস্থা করতে পারলে অনেকাংশেই দুর্ঘটনা রোধ করা যাবে। গতিবিধি না মেনে গাড়ি চালালে তার জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং তা প্রয়োগ করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমাদের একটু অসাবধানতা কেড়ে নিতে পারে অসংখ্য নিরপরাধ মানুষের প্রাণ। দুর্ঘটনায় যারা মারা যান তারা একেবারেই চলে যান, যারা আহত হন তারা হয়তো পরবর্তীকালে সুস্থ হন। কিন্তু যাদের অঙ্গহানি ঘটছে তাদের বাকি জীবনে আর সুস্থ হওয়ার বা হারানো অঙ্গ ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। তাদের জীবনটা নির্মম হয়ে পড়ে। গবেষণায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, চালকদের অশুভ প্রতিযোগিতা, নৌপথে বিরাজমান নৈরাজ্য দূর না করা, নৌযান চালকদের দায়িত্ব-কর্তব্যে অবহেলা, অদক্ষতা, ফিটনেসবিহীন নৌযান চলাচল করার সুযোগ পাওয়াসহ বিভিন্ন নৌযানে ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী বহন করাই হচ্ছে এসব দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। সরকারের একার পক্ষে কোনো কিছুই মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। নিজ নিজ দায়িত্ববোধ থেকে আমাদের এসব দুর্ঘটনা রোধে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসা উচিত। ঈদযাত্রা ও দুর্ঘটনা পর্যালোচনা করে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য মোটামুটিভাবে বিশ্লেষণ করা যায় যে, এবারের ঈদুল ফিতরে রাজধানী ঢাকা থেকে কমবেশি ১ কোটি মানুষ ঘরমুখী যাত্রা করবে। দেশের অভ্যন্তরে প্রায় ৫ কোটি মানুষ যাতায়াত করবে। গতবারের (২০২৩ সালের) ঈদুল ফিতরের আগে ও পরে ১৪ দিনে দেশে ২৪০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৮৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ৪৫৪ জন। গত বছর কোথাও তেমন অসহনীয় যানজট হয়নি। বিগত বছরগুলোর তুলনায় দুর্ঘটনাও অনেকটা কম ঘটেছিল। তবে ট্রেনের টিকিট শতভাগ অনলাইন করায় টিকিট সংগ্রহ করতে মানুষের ভোগান্তি হয়েছে। এর আগে ২০২২ সালের ঈদুল ফিতর উদযাপনের সময় ২৮৩টি দুর্ঘটনায় ৩৭৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছিল। এই হিসাবে গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের ঈদুল ফিতরে দুর্ঘটনা কমেছে ১৫.১৯ শতাংশ এবং প্রাণহানি কমেছে ২৪.২০ শতাংশ। ঈদযাত্রায় মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচলে বিধিনিষেধ না থাকা এবং পদ্মা সেতুতে গতি নিয়ন্ত্রণ ও লেন মানার শর্ত সাপেক্ষে মোটরসাইকেল চলাচলের সুযোগ থাকার কারণে সবগুলো মহাসড়ক ধরে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ লাখ মানুষ মোটরসাইকেলে গন্তব্যে ফিরেছে। ফলে বাস ও ট্রেনের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়েনি। মৃত্যু অনিবার্য, এটা চিরন্তন সত্য বটে। কিন্তু অস্বাভাবিক মৃত্যু তো মেনে নেওয়া কঠিন। তাই একটা কথাই অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আমাদের সবাইকে বিবেচনা করতে হবে। নানা দুর্ভোগ পেরিয়ে নাড়ির টানে ছুটে যাচ্ছেন আপন নিড়ে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে ঈদের আন্দন উপভোগ করতে। দূরপাল্লার পরিবহনে টিকিট না পেলেও কেউ কেউ ভেঙে ভেঙে গাড়িতে পাড়ি জমিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন পারিবারিক সদস্যদের ভালোবাসার টানে। ঈদের সুখ ভাগাভাগি করতে পথে যতই ভোগান্তি ও দুর্ভোগ হোক না কেন, পরিবার-স্বজনদের দেখা মিললে নিমিষেই মুছে যায় সব ব্যথা। আনন্দের ঈদযাত্রা যেন বিষাদে পরিণত না হয়, এই প্রত্যাশা সবার। শুভ হোক সবার ঈদযাত্রা। সৈয়দ ফারুক হোসেন : রেজিস্ট্রার, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর SHARES সম্পাদকীয় বিষয়: ফেরাবাড়িমানুষযাত্রা