সামাজিক উন্নয়নে স্থানীয় সরকার

প্রকাশিত: ২:৩৩ অপরাহ্ণ, এপ্রিল ২৪, ২০২৪

গণতন্ত্র আর উন্নয়ন একে অপরের পরিপূরক। অস্বচ্ছ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া কী উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে? এ নিয়ে সুধী সমাজে বিতর্ক থাকলেও স্থানীয় সরকারই উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে মুখ্য ভূমিকা পালন করে, এটি অস্বীকারের উপায় নেই। বাংলাদেশের মূল কাঠামোতে গণতন্ত্রের উপস্থিতি, অনুপস্থিতি নিয়ে ব্যাপক তর্ক-বিতর্ক আছে। আবার স্থানীয় সরকারে শাসক দলের প্রতিনিধিরা বিশেষ আনুকূল্য পেয়ে থাকেন, এমন অভিযোগও হরহামেশা শোনা যায়। এত সবের মাঝেও জোর দিয়ে বলা যায়, বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা এখনো যথেষ্ট শক্তিশালী। এর মূল কারণ তৃণমূলে শক্তিশালী গণতন্ত্রের উপস্থিতি। ইউনিয়ন পরিষদ স্থানীয় সরকারের মূল ভিত্তি। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর বাংলাদেশের স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের যে চিত্র দেখা যায়, পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেও এর নজির নেই।

অর্থবিত্তের অনৈতিক প্রভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে এখনো জনমতের প্রতিফলন ঘটে। সমাজে প্রভাবশালী মানুষের দম্ভ-দাপট যত বেশি দৃশ্যমানই হোক, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এখনো শান্তিপ্রিয়। তাই স্থানীয় সরকারে তাদের মতামতেরই প্রতিফলন দৃশ্যমান হয়। বিগত ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে যখন পরিবার, পরিজনের সমর্থনহীন প্রার্থী রেকর্ড সংখ্যক ভোটে জিতে যায়, তখন মূলত শক্তিশালী গণতন্ত্রের প্রক্রিয়াটির উপস্থিতিই প্রমাণিত হয়।

স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে প্রার্থীরা যে দল থেকেই নির্বাচিত হন, তারা মূলত শাসক দলের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকেই বাস্তবায়ন করেন। উন্নয়ন বরাদ্দ একটি রুটিন প্রক্রিয়া, সব জনপ্রতিনিধিই এ প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখেন। তবুও কেউ কেউ যুগ যুগ ধরে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন, আবার কেউ কেউ দ্বিতীয়বারেই বিপুল ভোটে হেরে যান। সরকারের রুটিন উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ, অনেক সময়ই পুনর্নির্বাচিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় প্রার্থীর ব্যক্তিগত কারিশমা এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রয়াত সৈয়দ মোহাম্মদ আলমগীর হবিগঞ্জ জেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। টানা সাত মেয়াদে আমৃত্যু ৩৫ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন। সাধারণের ভাষায় সামাজিক সংহতি ও শৃঙ্খলা রক্ষার অপূর্ব গুণাবলীর কারণেই জনগণ তাকে বারবার নির্বাচিত করেছে।

আমাদের গ্রামীণ সমাজে নানা কারণেই সামাজিক সংহতি ও শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়। জমিজমা নিয়ে বিরোধ, পারিবারিক কলহ, গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব এমন পরিস্থিতি হরহামেশাই ঘটে। আর এসব পারিবারিক ও সামাজিক বিরোধকে কেন্দ্র করে এক ধরনের সুবিধা ভোগী শ্রেণি তৈরি হয়। বিরোধের মাত্রা যতই বাড়ে, এই শ্রেণিটি ততই সমৃদ্ধ হয়। বিরোধকে কেন্দ্র করে বাড়তে থাকে মামলা-মোকদ্দমার সংখ্যা। মামলা-মোকদ্দমা আর দ্বন্দ্ব-সংঘাত যত বাড়ে সুবিধা ভোগীদের আয় রোজগারও সমহারে বাড়তে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জ্ঞাত অথবা অজ্ঞাতসারে জনপ্রতিনিধিরাও এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ভেঙে পড়ে সংহতি, বাড়তে থাকে সামাজিক অসন্তোষ। সমাজের শান্তিপ্রিয় মানুষগুলো গণতন্ত্রের সুবিধা নিয়ে পরবর্তীতে বিকল্প প্রার্থীকে নির্বাচিত করে তাদের মনের ক্ষোভ প্রকাশ করেন। প্রচার আছে, শুধু উন্নয়ন দিয়ে নয়, সামাজিক সংহতি রক্ষার সুদৃঢ় অবস্থানের কারণেই আমৃত্যু প্রায় চার দশক সৈয়দ মোহাম্মদ আলমগীর হবিগঞ্জ জেলার নোয়াপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন।

অনেকে অভিযোগ করেন, শাসক দলের বিপরীত আদর্শের অনুসারী জনপ্রতিনিধিরা সরকারের শ্যান দৃষ্টিতে থাকেন। সরকারের গৃহীত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সুদৃঢ় ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে সমর্থ হলে বিরোধী রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করেও জাতীয় পুরস্কার পাওয়া যায়, এমন উদাহরণও আমাদের সামনে দৃশ্যমান। তরুণ নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান সৈয়দ আতাউল মোস্তফা সোহেল। বয়স আর অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ এমন বলারও কোনো সুযোগ নেই। চিন্তা, চেতনায় শাসক দলের কেউ নন, তবুও জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রমে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে দেশসেরা চেয়ারম্যানের খ্যাতি অর্জন করেন। আওয়ামী লীগ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী তাজুল ইসলাম তার হাতে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা ও দায়িত্বের প্রতি অবিচল নিষ্ঠা থাকলে, মতাদর্শগত ভিন্নতা উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দিতে পারে না, এটি তার জ্বলন্ত উদাহরণ।